করোনাভাইরাস তথা কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খরচ অস্বাভাবিক রকমের বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, রোগ নির্ণয় ও ওষুধের খরচের এই পার্থক্যের পেছনে কারণ হলো, জাতীয় কোভিড-১৯ চিকিৎসার ওই প্রোটোকল অনুসরণ না করা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হেলথ ইকোনমিকস ইউনিটের (এইচইইউ) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসার জন্য সরকার গড়ে এক লাখ ২৮ হাজার টাকা ও আইসিইউতে করোনা রোগীর চিকিৎসায় চার লাখ ৮ হাজার টাকা খরচ করছে।
বেসরকারি কোভিড-১৯ হাসপাতালে এ খরচ অনেক বেশি::
বেসরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় প্রায় দুই লাখ ৪২ হাজার টাকা ও আইসিইউ বেডে প্রায় পাঁচ লাখ ৯ হাজার টাকা খরচ হয়, যার পুরোটাই রোগীরা বহন করেন।
এইচইইউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহায়তায় এই গবেষণাটি পরিচালনা করে। গবেষণা দলের নেতা এইচইউ’র উপ-সচিব ডা. মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘রোগ নির্ণয় ও ওষুধের খরচ সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর তুলনায় বেসরকারি হাসপাতালে অনেক বেশি। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা প্রোটোকলটি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না।
গবেষণাটিতে চারটি সরকারি ও দুটি বেসরকারি করোনা হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় থাকা ৩১ হাজার ১৪৭ জন রোগী ও আইসিইউ বেডে থাকা দুই হাজার ৯১৮ জনের চিকিৎসা খরচ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষণায় গত বছর এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী ও অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়।
ডা. নুরুল আমিন বলেন, ‘রোগীদের নিজস্ব পরিবহন খরচ, খাবার ও অন্যান্য খরচ আমরা গবেষণাটিতে অন্তর্ভুক্ত করিনি। এর মধ্যে কেবল চিকিৎসা চলাকালীন হাসপাতালে ব্যবস্থাপনার মধ্যে থাকা খরচ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সরকারি হাসপাতালে ক্ষেত্রে কর্মচারীদের বেতনে ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ, আবাসনে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ, ওষুধপত্রে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ, রোগ নির্ণয়ে ২ দশমিক ৪ শতাংশ, অক্সিজেন ও পিপিইতে ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ, খাবারে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, পরিষেবাগুলোতে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ ও সরঞ্জামে ১ দশমিক ৯ শতাংশ খরচ হয়ে থাকে।
ডা. নুরুল আমিন বলেন, ‘সরকার গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য কর্মীদের আবাসন, খাবার ও পরিবহন সুবিধা বাতিল করেছে, যা মোট ব্যয়ের ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ। ফলে, সরকারি হাসপাতালে মোট খরচ এখন আগের চেয়ে কম।
গবেষকরা জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা সরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে করা হলেও সাধারণ শয্যায় থাকা রোগীর ৬ হাজার ৪০০ টাকা ও আইসিইউতে থাকা রোগীর ৩৩ হাজার টাকা প্রয়োজনীয় ডায়াগনোসিস ও ওষুধের জন্য খরচ করতে হয়, যা সরকারি হাসপাতালগুলোতে পাওয়া যায় না।
বেসরকারি হাসপাতালে এক জন কোভিড-১৯ রোগীর খরচের সবচেয়ে বড় অংশটি হলো- ওষুধ কেনা, যা মোট খরচের প্রায় ৩০ শতাংশ। সরকারি হাসপাতালে ওষুধের খরচের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। অন্যদিকে, বেসরকারি হাসপাতালে ডায়াগনোসিসের খরচ মোট খরচের ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যা সরকারি হাসপাতালের তুলনায় সাতগুণ বেশি। অন্যান্য খরচের মধ্যে রয়েছে- কেবিন বা বেড ভাড়ায় ২০ দশমিক ৫ শতাংশ, চিকিৎসকদের খরচ ৫ দশমিক ৭ শতাংশ এবং অন্যান্য পরিষেবার ক্ষেত্রে ২৬ দশমিক ১ শতাংশ।
বেসরকারি হাসপাতালে থাকার গড় সময়কাল তুলনামূলকভাবে কম::
গবেষকরা জানান, একটি বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীর ভর্তি থাকার গড় সময়কাল সরকারি হাসপাতালের চেয়ে কম। সরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যায় থাকা কোভিড-১৯ রোগী গড়ে প্রায় ১০ দিন চিকিৎসা নেন, অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন ৬ দশমিক ৫২ দিন।
সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ বেডে এক জন কোভিড-১৯ রোগী গড়ে আট দিনের মতো চিকিৎসা পান, বেসরকারি হাসপাতালে তা ৭ দশমিক ৩৯ দিন।
একটি সরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় দৈনিক খরচ হয় গড়ে ১২ হাজার ৮১১ টাকা ও আইসিইউতে দৈনিক খরচ হয় গড়ে ৫১ হাজার ৬ টাকা। বেসরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় দৈনিক খরচ হয় গড়ে ৩৭ হাজার ১২৮ টাকা ও আইসিইউতে দৈনিক খরচ হয় গড়ে ৬৮ হাজার ৮৮৫ টাকা।
ঢাকার সায়েদাবাদ এলাকার হালিম গত সপ্তাহে তার বাবাকে বারডেম হাসপাতালের আইসিইউ থেকে ডিএনসিসি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালে নিয়ে আসেন। ডিএনসিসি হাসপাতাল চত্বরে এই সংবাদদাতাকে তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যেই দৈনিক এক লাখ ৫০ হাজার টাকারও বেশি খরচ করেছি, বেশিরভাগই ওষুধ, আইসিইউ ভাড়া ও ডায়াগনোসিসের জন্য। আমরা বারডেমের খরচ বহন করতে পারছি না। হাসপাতালের বাইরের খরচ যোগ করা হলে এ খরচ আরও বেড়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আহমেদ আবু সালেহ বলেন, ‘এটি একটি নৈতিক বিষয়। জাতীয় চিকিৎসাা প্রোটোকলটি সরকারি ও বেসরকারি উভয় স্বাস্থ্যখাতের বিশেষজ্ঞদের দ্বারাই তৈরি করা হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালের উচিত এটি অনুসরণ করা। তা না হলে, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের মতো সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরও এটি খতিয়ে দেখা উচিত।