খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীর কোন এলাকায় ভবন নির্মাণ হওয়ার সংবাদ পেলেই ওই এলাকার ইমারত নির্মাণ পরিদর্শক বা ইন্সপেক্টর পরিদর্শনে যান। তাদের খুশি করতে পারলে ইচ্ছেমত ভবন নির্মাণ করা যায়। অন্যথায়, নকশার এক চুল পরিমাণও পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ নেই।
চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে খাল দখলমুক্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, ১২০ কিলোমিটার খালের জায়গায় ও আশপাশে গড়ে উঠেছে প্রায় ৩ হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা। এরমধ্যে বহুতল ভবনের সংখ্যা ৩১০টি। এর থেকে কিছুটা অনুমান করা যায়, ১ হাজার ১৫২ বর্গ কিলোমিটার সিডিএ’র আওতাধীন এলাকায় নকশা বহির্ভূত বা অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যা কত হতে পারে।
নগরীর খুলশী এলাকায় একটি ১৬ তলা ভবনের অনুমতি নিয়ে ১৮ তলা নির্মাণ করা হয়েছে। একই সাথে ইউএসটিসির ওই ভবনের তিন হাজারের বেশি বর্গফুট ভবন নির্মাণ করা হয়েছে খালের জায়গা দখল করে। গত বুধবার চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ওই ভবনের অবৈধ অংশ ভেঙে দিয়েছে। অন্যদিকে, নগরীর আগ্রাবাদ কমার্স কলেজ রোর্ডে পাঠানটুলি এলাকায় একটি ১০ তলা ভবনের অনুমতি নিয়ে ১৪ তলা নির্মাণ করেছে। সিডিএ’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এই ভবন নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। এক মামলায় ওই ভবন মালিককে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত এবং সিডিএকে ওই ভবনের অবৈধ অংশ ভাঙার নির্দেশ দেন। একইভাবে, বাকলিয়া এলাকায় একটি ১০ তলা ভবনের কারণে ‘বাকলিয়া এক্সেস রোড’ নামের একটি প্রকল্প আটকে আছে।
সিডিএ’র বোর্ড সদস্য স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, ৬০-৭০ লাখ মানুষের বসবাস চট্টগ্রাম শহরে। সিডিএ’র মত একটি প্রতিষ্ঠান একা তো সব ভবন সঠিকভাবে নির্মাণ হচ্ছে কিনা তা তদারকি করতে পারবে না। তাই আমাদেরও সচেতন হতে হবে। এছাড়া, সিডিএ’র বর্তমান জনবল দিয়ে নির্মাণাধীন ভবন তদারকি সম্ভব না। মানুষের সচেতনার পাশাপাশি সিডিএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আরো দায়িত্বশীল হতে হবে।
সিডিএ’র এই বোর্ড সদস্য আরো বলেন, অনেকেই তথ্য গোপন করে বা ‘সিডিএকে ম্যানেজ’ করে নকশা বহির্ভূত ভবন নির্মাণ করেন। কেউ ৫ তলা অনুমোদন নিয়ে ৭ তলা ভবন নির্মাণ করেন। আবার এক জায়গার ড্রয়িং-ডিজাইন দেখিয়ে অন্য জায়গায় ভবন নির্মাণ করছেন। এক্ষেত্রে আর্থিকভাবে লোকসান হলেও অনুমোদনহীন বা নকশা বহির্ভূত ভবন ভেঙে দিয়ে মানুষকে শিক্ষা দেয়া উচিত বলে মনে করছি। তাহলে মানুষ অনুমোদনহীন বা নকশা বহির্ভূত ভবন নির্মাণ করবেন না।
জানতে চাইলে স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ জেরিনা হোসেন বলেন, সিডিএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘ম্যানেজ’ করা ছাড়া কখনো নকশা বহির্ভূত ভবন নির্মাণ সম্ভব না। যেখানে সাধারণ মানুষ বাড়ি নির্মাণ করতে গেলে সিডিএ’র পরিদর্শক একাধিকবার হাজির হয়, সেখানে ১০ তলার অনুমোদন নিয়ে ১৪ তলা ভবন নির্মাণ হয়ে যায়। কিন্তু সিডিএ জানে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাই এই নগরকে পরিকল্পিত করতে হলে, প্রথমে সিডিএকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিডিএ’র প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, বছরে প্রায় আড়াই হাজার ভবনের অনুমোদন দিয়ে থাকে সিডিএ। একটি প্ল্যান অনুমোদন নেয়ার পর তিন বছর পর্যন্ত মেয়াদ থাকে। অর্থাৎ তিন বছরের মধ্যে যে কোন সময়ে ওই ভবনের কাজ শুরু করা যাবে। তাহলে ভবন মালিক যদি কাজ শুরু করার সময় সিডিএকে না জানায়, তাহলে সিডিএ’র পক্ষ থেকে তা জানা কঠিন হয়ে পড়ে।
এক প্রশ্নের উত্তরে সিডিএ’র এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সিডিএ’র কিছু ‘কর্মকর্তা-কর্মচারী’ ভবন মালিকের কাছে ‘ম্যানেজ হয়ে’ নীরব থাকার অভিযোগ আমরাও শুনেছি। তা না হলে এত নকশা বহির্ভূত এবং বহুতল ভবন কিভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে’।
উল্লেখ্য, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী, নতুন ভবন নির্মাণ কাজ শুরুর বা স্থগিত কাজ শুরুর ১৫ দিন আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অবহিত করার কথা থাকলেও তা করেন না অধিকাংশ ভবন মালিক। এছাড়া, কোন কারিগরি ব্যক্তিকে নতুন নিয়োগ বা পরিবর্র্তন সম্পর্কে ১৫ দিনের মধ্যে জানাতে হবে। বিধিমালায় আরো বলা হয়েছে, ইমারতের দায়িত্বপ্রাপ্ত কারিগরি ব্যক্তির গাফিলতি হিসাবে গণ্য হবে, যদি তিনি কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই নির্ধারিত ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশনের সাথে যুক্ত এমন কোন প্রয়োজনীয় তথ্য ও বিবরণ সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রদান বা গোপন করেন। এছাড়া, যদি তিনি কাঠামো নকশা, অগ্নিনির্বাপক অথবা অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে ভুল তথ্য পরিবেশন করেন এবং এড়িয়ে যান।