মো:নাজমুল হোসেন রনি:
পার্বত্য জেলা রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নে আজকের এই দিনে চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ।
২০ শে এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালে পাকিস্থানি শত্রু বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন দেশের এই সূর্য সন্তান। নানিয়ারচর বাসীর জন্য বেদনাদায়ক একটি অধ্যায় স্বরন করিয়ে দেয় এই দিনটি। শত্রুর মটার শেল মৃত্যু নয়, বরং অমৃত স্বাদ বীরশ্রেষ্ঠ পদে ভূষিত করেছে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ২নং কমান্ডো ব্যাটেলিয়ানের দুই কোম্পানি সৈনিক ৭টি স্পিড বোট ও ২টি লঞ্চযোগে রাঙামাটি-মহালছড়ি নৌপথের আশেপাশে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ করে। লঞ্চগুলোতে ৬টি মর্টার সজ্জিত ছিলো। পাকিস্তানী বাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থান টের পাওয়া মাত্রই তাদের অবস্থানের উপর মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করে। তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।
পাকিস্তানী বাহিনীর কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের মর্টার শেল আর ভারী অস্ত্র দিয়ে চালানো আক্রমণে বেকায়দায় পড়ে যায় মুক্তিবাহিনী। এসময় পাকিস্থানি বাহিনীকে প্রতিহত করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন মুন্সি আব্দুর রউফ। হঠাৎ একটি গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তার দেহ।
স্থানীয় দয়াল কৃষ্ণ চাকমা তার মরদেহ উদ্ধার করে চিংড়ি খালের পাশে একটি দ্বীপে সমাহিত করেন। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর উদ্যোগে এই দ্বীপে নির্মিত হয় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের সমাধি সৌধ।
পার্বত্য অঞ্চলের দূর্গম প্রান্তিক এলাকা নানিয়ারচরের বুড়িঘাটে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া এই বীর সেনাকে পার্বতাঞ্চলের মানুষ ও নানিয়ারচর উপজেলাবাসী এলাকার গর্ব হিসেবে মনে করেন।
এদিকে জাতির এই বীর সেনাকে এলাকার বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন গভীরভাবে শ্রদ্ধার সাথে স্বরন করার কথা থাকলেও চলমান করোনা পরিস্থিতিতে তা সম্ভব হয়নি।
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ স্মৃতি সংসদের প্রতিষ্ঠাতা মোঃ মিজানুর রহনান বলেন, এই দিনটি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্বরন করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কিন্তু এই ২বছর চলমান করোনার লকডাউনে সব বিষাদময় লাগছে।
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের শাহাদাৎ বার্ষিকী নিয়ে মতানৈক্য আছে। কেউ বলেন ৮ই এপ্রিল, কেউ বা মনে করেন ১১ই এপ্রিল। আবার কেউ বলেন ২০শে এপ্রিল।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ে গবেষক, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা, বিশিষ্ট লেখক ও আরটিভি প্রতিনিধি ইয়াসিন রানা সোহেল বলেন, পাকিস্থানি বাহিনী রাঙামাটি দখলে নিয়েছিল ১৪ই এপ্রিল। সেই হিসেবে রাঙামাটিতে ৮ কিংবা ১১ই এপ্রিল যুদ্ধ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। ১১ই এপ্রিল কালুরঘাট পতনের পরে ১৩ই এপ্রিল বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের দল রাঙামাটি হয়ে লঞ্চযোগে মহালছড়ি হেড কোয়াটারে যোগদান করেন। সেই সময় মেজর মীর সৈকত ছিলেন সেখানকার কমান্ডার।
তিনি আরো বলেন, মহালছড়ি মুক্তিবাহিনী গোয়েন্দা সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারেন পাকিস্থানি বাহিনী রাঙামাটি থেকে লঞ্চ যোগে বুড়িঘাট হয়ে মহালছড়ি হানা দিবে। ১৯শে এপ্রিল পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীকে রুখতে মেজর মীর সৈকতের নির্দেশে এবং লেফটেন্যান্ট খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে শতাধিক সেনাবাহিনী, ইপিআর ও মুক্তিবাহিনীর একটি দল নানিয়ারচরের বুড়িঘাটে চেঙ্গী খাল পরিদর্শন করে এবং ২০শে এপ্রিল সকালে খালের পাড়ে অবস্থান নেয়। সেদিন পাকিস্থানি ও মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ শাহাদাৎ বরণ করেন।
শাহাদাৎ বার্ষিকী পালন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এই লেখক আরো জানান, প্রতি বছর বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ এর জন্মবার্ষিকী ও শাহাদাৎ বার্ষিকী পালনের উদ্যেশ্যে আমরা বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করি। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠার পরে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে আমরা জন্মবার্ষিকী এবং শাহাদাৎ বার্ষিকী পালন করি। কিন্তু চলমান করোনা পরিস্থিতিতে ২০২০ ও ২০২১ সালে আমরা স্বরনীয় এই দিনটি পালন করতে পারিনি। এটা আমাদের জন্য একটি বেদনাদায়ক বিষয়।