লেখক:-তারিকুল আলম,
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট,
নোয়াখালী।
নারী নির্যাতনের নৃশংসতম একটি পদক্ষেপ হচ্ছে এসিড নিক্ষেপ। এসিড সন্ত্রাসের পরিণতিতে একজন নারীর শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয় । আমরা বা অন্যরা এক্ষেত্রে শুধু সহানুভূতি জানাতে পারি। এসিড নামক রাসায়নিক এ দাহ্য পদার্থটির ভয়াবহতা এত ব্যাপক যা চামড়ার নিচের টিস্যু, এমনকি হাড় পর্যন্ত গলিয়ে দেয়। এসিড সন্ত্রাসের যে কোনো ঘটনা মনুষ্য চেতনাকে আহত করে। বাংলাদেশে এসিড সন্ত্রাসজনিত অপরাধকে এখন যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তির বিধান। কিন্তু আইন যথেষ্ট হলেও যথাযথ প্রয়োগের বিষয়টি সেভাবে নিশ্চিত হয়নি। প্রয়োগের দুর্বলতার কারণে সেই আইনের ভালো দিকগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আক্রান্তরা।
২০০২ হতে ২০২০ পর্যন্ত ১৬ বছরে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনায় সারা দেশে মামলা হয়েছে ২,১৬৯ টি। অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি দাবি করে ৮৬৬টি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে সাজা হয়েছে, এমন মামলার সংখ্যা মাত্র ১৯৯। খালাস পেয়ে গেছেন ১ হাজার ৯৫০ আসামি। এর মধ্যে ৩৯% মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি দাবি করে পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন (এএসএফ)-এর হিসাব অনুযায়ী ২০১২ সাল থেকে ২০২০ সালের শেষার্ধ্ব পর্যন্ত সারাদেশে ৩,০৮৬টি এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। আর এতে আহত হয়েছে অন্তত ৩,৩৯২ জন। এছাড়া গত ১৮ বছরে প্রায় দেড় হাজার নারী ও শিশু এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। সাজা হয়েছে মাত্র ৩৪৩ জনের। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী এসিডের মামলায় গত ১৬ বছরে ১৪ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আমাদের দেশে এসিড নিক্ষেপ নারী নির্যাতনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রেম বা বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হলেই মানুষ নামের নরপশুরা এসিড নিক্ষেপ করে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে। শুধু আইন বা এর প্রয়োগে এ অপরাধ দমন করা যাবে বলে মনে হয় না। এর বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করার ব্যাপারে সরকারকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। এসিড নিক্ষেপের মতো নৃশংস অপরাধ নির্মূল করতে জনসচেতনতা সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এই সন্ত্রাসের ব্যাপকতা তুলনামূলকভাবে পৃথিবীর যে কোনো দেশের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত। উগ্র ও ধ্বংসাত্মক এ সন্ত্রাসের ভয়াবহতা থেকে আজকাল শিশু, বৃদ্ধ এমনকি পুরুষরাও রেহাই পাচ্ছে না। এ সন্ত্রাস রুখতে সংশ্লিষ্ট আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং এসিডের সহজলভ্যতা রুখতে হবেই।
তাই আইনের বাস্তবায়নের পাশাপাশি নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মতামত দেন বিশেষজ্ঞগণ। নারীর প্রতি সহিংসতা, বর্বরতা, পৈশাচিকতা রোধে সম্মিলিতভাবে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি আইনি প্রতিকারের কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি-
১) পরিবার হচ্ছে সর্বপ্রথম ও প্রধান ভিত্তি স্তর যেখানে একটি শিশু সম্পূর্ণ মানুষ রূপে গড়ে ওঠে। পরিবারে একে অন্যের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান ও মর্যাদার মনোভাব নিয়ে বেড়ে না উঠলে এর নেতিবাচক প্রভাব পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে পড়বেই। পরিবারে যদি ছেলেদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া যায়, তবেই পরিবর্তন আশা করা যায়।
২) স্কুল, কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ালেখার পাশাপাশি সমান গুরুত্ব দিয়ে তাদের মধ্যে নৈতিকতাবোধ এবং সহপাঠীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করে দিতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য তার যে দায়িত্ব বা ভূমিকা তা তাকে বোঝাতে হবে। এসিড নিক্ষেপের ফলে একটি জীবন ও পরিবারের নির্মম পরিণতি তাদের জানাতে হবে। সকল পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত, নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে তা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
৩) নারীদের বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য যত ধরনের আইন করা হয়েছে তা থেকে নারীরা কতটা সুফল পাচ্ছে -এ বিষয়টি নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। তাই নারীর প্রতি নির্যাতন রোধে যেসকল আইন আছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রচলিত আইনের সঠিক ও কঠোর প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে হবে।
৪) এসিড সন্ত্রাসের শিকার হলে সহজেই যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সাহায্য নেওয়া যায়, এ জন্য পর্যাপ্ত হেলপ লাইন থাকতে হবে। তবে যাদের বিরুদ্ধে নালিশ করা হবে, তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিচয় তথা ক্ষমতার দাপট যদি প্রবল হয়, তাহলে অনেক ক্ষেত্রে পরবর্তী অবস্থা সামলানো একজন ভিকটিমের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। এ কারণে অনেকে বিষয়টি নীরবে সহ্য করে যায়। তাই সামাজিকভাবে জোরালো ঐকমত্য সৃষ্টি করা দরকার, যাতে কোনো অভিভাবক, ক্ষমতাধর ব্যক্তি, কোনো কর্তৃপক্ষ যেন এসিড নিক্ষেপকারীদের প্রশ্রয় না দেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টা ধারাবাহিকভাবে কার্যকর থাকলে এ ধরনের অপরাধ এক সময় নির্মূল হয়ে যাবে আশা করা যায়। এছাড়া দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হলে পরবর্তীতে অন্য অপরাধীদের দৌরাত্ম্য কমে আসবে।
৫) পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর বেড়ে ওঠা ও সামাজিকীকরণ ঘটে নাজুকতার মধ্য দিয়ে, এর সুযোগ নেয় অপরাধীরা। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সব মানুষের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই এই সমস্যা প্রতিহত করা সম্ভব হবে।
এসিড বিক্রিতে মানা হয় না বিধি নিষেধ- মূলত তাঁত, স্বর্ণ ও ব্যাটারি কারখানার জন্য এসিড প্রয়োজনীয় একটি উপাদান হলেও আলু-পটলের মতো নির্বিচারে দেশের সর্বত্র এর কেনাবেচা চলছে। এছাড়া কিছু জেলার সীমান্ত এলাকায় চোরাইপথে আসা এসিড একটি সহজলভ্য পণ্যে পরিণত হওয়ায় যে কেউ খুব সহজেই তা সংগ্রহ করে মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলছে। লাইসেন্সভুক্ত প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কারও কাছে এসিড বিক্রি করার নিয়ম নেই। কেন এ নিয়মটি কঠোরভাবে মানার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের বাধ্য করা হচ্ছে না- সরকারের কাছে সেটাই আমার প্রশ্ন। সমাজ থেকে এসিড সন্ত্রাস নির্মূল করতে হলে সর্বাগ্রে এর ব্যবহার কঠোর নজরদারির আওতায় এনে তা নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি এসিড সংক্রান্ত মামলার রায়ে দীর্ঘসূত্রিতা পরিহারের পাশাপাশি আইনের ফাঁক গলিয়ে অপরাধী যাতে পার পেয়ে না যায়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার এসিড সন্ত্রাস দমন আইন প্রণয়ন করে। এ আইন অনুযায়ী ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ করার কথা বলা আছে। অভিযুক্তদের দ্রুত বিচারের পাশাপাশি এসিডের ব্যবহার, মজুত ও বিক্রির ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এসিড নিক্ষেপকারীর জামিন না-মঞ্জুর ও এক বছরের মধ্যে তাদের বিচার শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়, আগে যেখানে বছরের পর বছর লেগে যেত। অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তি দেয়ার বিধান করা হয়েছে। বাংলাদেশের দণ্ডবিধি ১৮৬০ অনুযায়ী এসিড ছোড়ার শাস্তি হিসেবে রয়েছে সর্বনিন্ম ৭-১২ বছরের জেল বা সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এই আইন বিদ্যমান থাকলেও অনেক সময় আইনের অপর্যাপ্ততা ও প্রয়োগ না করার কারণে এসিড নিক্ষেপকারী দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৩০% এসিড নিক্ষেপকারী দোষী সাব্যস্ত হলেও উচ্চাদালতে তাদের আপিলের কারনে দণ্ড স্থগিত হয়ে যায়। বর্তমানে প্রায় ৩০০ টি মামলা নিন্ম আদালতে প্রক্রিয়াধীন আছে। তথ্যের অপর্যাপ্ততার কারনে অধিকাংশ মামলা যথাযথ ভাবে তদন্ত করা সম্ভব হয় না। ফলে এসিড নিক্ষেপকারী ছাড় পেয়ে যায় ও বাদী উপযুক্ত বিচার পায় না।
দেশের প্রচলিত আইনে এসিড সন্ত্রাসের কঠোর শাস্তির বিধান থাকলেও তার প্রয়োগ সীমিত। অপরাধীরা মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টদের প্রভাবিত করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পার পেয়ে যায়। এ অবস্থার প্রতিরোধে এসিড সন্ত্রাসের তদন্ত ও বিচারের সময় নির্দিষ্ট করে দেয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। তদন্তের ক্ষেত্রে তদন্ত কর্তৃপক্ষের গাফিলতি থাকলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণেরও বিধান থাকতে হবে। এসিড সন্ত্রাসে জড়িতদের সাজা বৃদ্ধিরও উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এর পাশাপাশি যৌক্তিক কারণ ছাড়া এসিড ক্রয়-বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও ভাবা যেতে পারে। কোনো মানুষের ওপর এসিড নিক্ষেপ তাকে হত্যা করার চেয়েও জঘন্য অপরাধ। এ অপরাধের শিকার যারা তাদের সারা জীবন বিড়ম্বনার মধ্যে কাটাতে হয়। এমন বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুবরণও অনেক সময় কাম্য হয়ে দাঁড়ায়। এ অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের কোনোভাবেই ক্ষমা পাওয়া উচিত নয়। এ সন্ত্রাস নির্মূলের কর্মসূচিতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্পৃক্ততা নিশ্চিতের বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে। এসিড সন্ত্রাসের মতো দুঃখজনক এ উপাখ্যানের পরিসমাপ্তি ঘটাতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও দোষীদের শাস্তি প্রদানের বিষয়ে আরও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র:
(i) www.bbc.com
(ii) www.bdlaws.minlaw.gov.bd
(iii) www.banglapedia.org