লেখক:- তারিকুল আলম
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট
নোয়াখালী
কৃষি বনায়ন বিশ্বব্যাপী একটি সনাতন বহুমূখী উৎপাদন পদ্ধতি। কিন্তু বিজ্ঞান হিসেবে এর পরিচিতি নতুন। অবহেলিত এ পদ্ধতিটি ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি এসে পরিকল্পিত ভূমি ব্যবস্থাপনা হিসেবে বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করে, যা এ শতকের শেষভাগে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তত্ত্বগতভাবে কৃষি বনায়নের বহুবিধ উপকারিতার কথা বহুল প্রচলিত থাকলেও কারিগরিভাবে এর বিভিন্ন দিক এখনও প্রমাণের অপেক্ষায় রয়েছে। বাংলাদেশে এ পদ্ধতি স্বল্পপরিসরে বহুপূর্ব থেকে প্রচলিত হলেও বৃহত্তর পরিসরে এখনও তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। এ পদ্ধতিকে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় করার জন্য প্রয়োজন কৃষি বনায়ন সম্পর্কে সম্যক ধারণা।
কৃষি বনায়ন একটি অতি প্রাচীন ও সনাতন ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং উৎপাদন পদ্ধতি, যা যুগ যুগ ধরে কৃষকগণ অনুসরণ করে আসছেন। বাংলাদেশেও এ পদ্ধতি/চর্চা দীর্ঘ সময় ধরে কৃষকগণ অনুসরণ করে আসছেন। যুগ যুগ ধরে মানুষ সনাতনি ধারায় একই খামারে বা ভূমিখন্ডে একইসাথে ফসল, বৃক্ষ, পশুপাখি, ইত্যাদি উৎপাদন করে আসছেন। বাংলাদেশের চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে ঝুম চাষ পদ্ধতি অতি পুরাতন চর্চা। এছাড়া টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলে এবং গাজীপুরের শ্রীপুর ও কাপাসিয়া অঞ্চলে কাঁঠাল/আম গাছের নিচে আনারস, আদা, হলুদ ও অন্যান্য শাকশবজির চাষ; সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে বনের মধ্যে লতাজাতীয় শাকশবজি, মসলা ইত্যাদির চাষ; ফরিদপুর, বরিশাল, মাগুরা ও নড়াইল এলাকায় জমির আইলে তাল গাছের চাষ; পাবনা, রাজশাহী, কুষ্টিয়ার গঙ্গা নদী পাবিত উঁচু কৃষি জমিতে বাবলা গাছের চাষ অতি পুরাতন সনাতন কৃষি বনায়নের উদাহরণ।
কৃষি বনায়নের সংজ্ঞা- সাধারণভাবে কৃষি বলতে কৃষি জমিতে বিভিন্ন ধরনের কৃষিজ পণ্য, যেমন- শস্য, শাকশবজি, পশুখাদ্য উৎপাদন এবং হাঁসমুরগি, গবাদিপশু পালন ইত্যাদি বুঝায়। তেমনিভাবে বনায়ন বলতে বনভূমিতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে গাছ লাগানো, পরিচর্যা ও সংরক্ষণকে বুঝায় যা থেকে সর্বাধিক পরিমাণ বনজ দ্রব্য, যেমন- কাঠ, জ্বালানি, গৃহ ও আসবাবপত্র তৈরির সামগ্রী, মধু, বনৌষধ, মোম ইত্যাদি পাওয়া যায়।
কৃষি বনায়ন হচ্ছে এমন একটি টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, যা ভূমির সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধি করে, যুগপৎ বা পর্যায়ক্রমিকভাবে কৃষিজাত ফসল,বৃক্ষজাত ফসল ও বনজ উদ্ভিদ এবং/অথবা পশুপাখিকে একত্রিত/সমন্বিত করে এবং সেসব পরিচর্যা পদ্ধতি অবলম্বন করে, যা ঐ নির্দিষ্ট এলাকার জনগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক ধ্যানধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আন্তর্জাতিক কৃষি বনায়ন গবেষণা কেন্দ্র এর সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘‘কৃষি বনায়ন হচ্ছে এমন একটি ভ‚মি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি যার মাধ্যমে একই ভ‚মিতে সুবিবেচিতভাবে বৃক্ষ, ফসল ও পশুখাদ্য উৎপাদন করা হয়, যাতে একে অন্যের উৎপাদনকে ব্যাহত না করে, পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে এবং যা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়।’’
কৃষি বনায়নের প্রয়োজনীয়তা- বাংলাদেশ একটি ঘন বসতির দেশ। মাত্র ১ কোটি ৪৩ লক্ষ হেক্টর ভূমির উপর প্রায় ১৭ কোটি লোক বসবাস। এদেশে মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ মাত্র ০.১ হেক্টর এবং বনভূমির পরিমাণ ০.০১৬ হেক্টর। জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধি (বছরে প্রায় ২.১৭%) জমির উপর ক্রমাগত বর্ধিত চাপ সৃষ্টি করে চলেছে অর্থাৎ মাথাপিছু জমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি মানব জীবনের এক মৌলিক ও অব্যাহত প্রক্রিয়া বিধায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেও শূন্যের কোঠায় আনা সম্ভব হবে না। এ বর্ধিত জনসংখ্যার বাসস্থান ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য কৃষি জমি বা বনভূমি অবশ্যই সংকুচিত হবে। এ অবস্থা মোকাবেলার জন্য এ মুহর্তে প্রয়োজন সঠিক নীতি ও বিজ্ঞানসম্মত কর্মকৌশল। কৃষি ও বনসম্পদ ব্যবস্থাপনায় এমনকিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন যা বর্ধিত জনগোষ্ঠির মৌলিক চাহিদা পূরণ করবে এবং পরিবেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করবে। এ প্রেক্ষাপটে ‘‘কৃষি বনায়ন’’ এক গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশ্বের বিভিনড়ব দেশে কৃষকের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এবং পরিবেশ সংরক্ষণে এ প্রযুক্তি সফল কলাকৌশল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে ।
কৃষি বনায়ন গ্রামীণ কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় আনতে পারে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন, এতে একদিকে সৃষ্টি হবে সম্পদ অন্যদিকে গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হবে যা জনগণের দারিদ্র বিমোচনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। সার্থক কৃষিবনায়ন পরিবেশ সংরক্ষণেও এক যুগান্তকারী অবদান রাখতে পারে। ইতোমধ্যে এ প্রযুক্তি জনগণের মাঝে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে।
কৃষি বনায়ন পরিকল্পনা- কৃষি বনায়ন কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত ও কার্যকরী করার জন্য প্রয়োজন কারিগরী দিক থেকে যুক্তিসঙ্গত প্রস্তাবনা বা পরিকল্পনা। ভূ-কাঠামোগতভাবে বাংলাদেশকে ৩টি প্রধান অঞ্চলে ভাগ করা যায়। যথা- উঁচু ভূমি, প্লাবন সমভূমি এবং পার্বত্য অঞ্চল এ তিনটি ভূ-কাঠামো অঞ্চলের অধিকাংশ জায়গায় কৃষি বনায়ন চর্চার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, হাওড়, বিল বা বছরের অধিকাংশ সময়ে পানি থাকে এ ধরনের স্থান এবং গভীর অরণ্যে এ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের সম্ভাবনা ক্ষীণ। কৃষি বনায়নের সম্ভাব্য এলাকা সমূহে এ কার্যক্রমকে সম্প্রসারণ ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
কৃষি বনায়নের সম্ভাব্য স্থানসমূহ- ১. বসতবাড়ির আঙ্গিনা ও তৎসংলগড়ব জমি, ২. কৃষি ফসল জমি/কৃষি খামার, ৩. পতিত ও প্রান্তিক জমি, ৪. ক্ষয়প্রাপ্ত ও পুনঃসৃষ্ট বনাঞ্চল, ৫. সড়ক, রেলপথ এবং বাঁধসংলগড়ব এলাকা, ৬. পুকুর, নদী, খাল, বিল ও অন্যান্য জলাশয়ের পাড়, ৭. উপকূলীয় অঞ্চল এবং ৮. অন্যান্য উন্মুক্ত স্থান, যেমন- হাটবাজার, খেলার মাঠ, উপাসনালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।
দেশের অধিকাংশ মানুষ খাদ্য চাহিদা পূরণ ও জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষিকাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ক্রমহ্রাসমান আবাদযোগ্য জমি বর্তমানে কৃষকের জীবন ও জীবিকা নির্বাহের অন্যতম প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবাদযোগ্য কৃষি জমি হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে ব্যাপকভাবে। ফলে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা নিশ্চিতকরণ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থেই কৃষির বহুমুখীকরণ তথা সমন্বিত ভূমির ব্যবহার এখন সময়ের দাবি।
এমনই এক বহুমুখী সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস্থাপনার নাম হল কৃষি বনায়ন, যা পরিবেশের উপকরণগুলো যেমন- গাছপালার সঙ্গে কৃষিজ ফসল, গবাদি পশুপাখি, হাঁস-মুরগি, মৎস্য ইত্যাদির সমন্বিত ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উৎপাদন, ভূমির জৈব পদার্থ বৃদ্ধি, সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সর্বোপরি পরিবেশের ভারসাম্য নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি জ্বালানি কাঠ, গো-খাদ্যের চাহিদা পূরণ, ভেষজ চিকিৎসা ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামাল সরবরাহে কৃষি বনায়নের ভূমিকা অপরিহার্য। আমাদের দেশে কৃষি বনায়নের ব্যাপক সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। আবাদি জমি ছাড়াও পতিত জমিগুলো যেমন- বসতবাড়ির আঙিনা, কৃষি জমির আইল, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আঙিনা, সড়ক ও রেললাইনের ঢাল, বাঁধ ও ঢালু জমি, নদীর তীর, চর অঞ্চলে কৃষি বনায়নের সুযোগ রয়েছে ব্যাপক। দেশের দুর্গম চরাঞ্চল তথা সমগ্র দেশের প্রান্তিক কৃষকদের জীবিকা নিশ্চিতকরণ, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণসহ দারিদ্র্য বিমোচনে কৃষি বনায়ন এক অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মাচন করেছে।
তথ্যসূত্র:
(i) www.ais.gov.bd
(ii) www.banglapedia.org