মোঃ আলী আকবর
মুসলিম মনিষীরা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাদের জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ গুলো আমাদের জন্য শিক্ষা হতে পারে।বর্তমানে ইসলামি শিক্ষা প্রচারের অভাবে আমরা মনিষিদের ভূলতে বসেছি। আজ আমাদের জাতিগত পরিচয় জানিনা । বর্তমানে মুসলিম সন্তানরা মুসলিম মনীষীদের আইডল মনে না করে বিভিন্ন অনৈসলামিক চরিত্রকে আইডল মনে করছে। তাদের অনুস্বরণ করছে। জাতিগত পরিচয়ে যে গর্ব তা ভূলতে বসছে। এ সব স্মরণ করতে বিভিন্ন ইসলামি মনিষীদের নিয়ে লিখা।আজ থাকছে ইসলামি রেনেসাঁর অগ্রদূত বায়তুশ শরফের প্রধান রূপকার হাদিয়ে যামান শাহ্সূফী
হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ:) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী। যে মহান আধ্যাত্মিক সাধকের নামে এ প্রবন্ধ, তিনি দেশ-বিদেশের প্রতিটি অঞ্চলে এক নামে সুপ্রসিদ্ধ। আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ হতে তিনি ছিলেন এতদঅঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য প্রেরিত আশীর্বাদ স্বরূপ। ক্ষণজন্মা এ সাধক বায়তুশ শরফের প্রধান রূপকার শাহ্সূফী হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ.)।
বায়তুশ শরফের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবুল আলম শাহ্সূফী হযরত মাওলানা মীর মোহাম্মদ আখতর (রহ:) ১৯৭১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ২৯তম পবিত্র হজ্ব পালনকালে আরাফায় অবস্থান শেষে মিনার হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের পূর্বে পবিত্র কা’বা শরীফকে সামনে রেখে খেলাফতের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন তাঁরই সুযোগ্য খলীফা হাদিয়ে যামান শাহ্সূফী হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ:) এর উপর। উল্লেখ্য, তিনি স্বীয় পীর-মুর্শিদের জীবদ্দশায় ১৯৬০ সাল হতেই তাঁর (২ অক্টোবর ১৯৫২ সালে) প্রতিষ্ঠিত আন্জুমনে ইত্তেহাদ নামক ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের সভাপতির মহান দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
বাল্যকাল হতে কঠোর অধ্যবসায়, প্রখর মেধা ও আধ্যাত্মিকতায় তিনি ছিলেন চির-ভাস্বর। তাঁর এ সুপ্ত আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধিত হয় আলিম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায়। ১৯৪৭ সালে পবিত্র শবে বরাতে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন জামে মসজিদের হুজরাখানায় নিজ পীর-মুর্শিদের হাতে বায়াত হওয়ার মধ্য দিয়ে।
তিনি ছিলেন সুন্নতে নববীর বাস্তব অনুসারী। তাঁর সমুদয় কর্মকা- ছিল একমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন করার উদ্দেশ্যে, নিছক কোন ব্যক্তি স্বার্থ ছিলনা তাঁর। এটাই ছিল তাঁর অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাঁর আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা দেখে তাঁর পীর-মুর্শিদ বলেন, “মাওলানা আবদুল জব্বার সাহেব হচ্ছেন কুতুবুল আকতাব। তাকে ছোট মনে করলে ধ্বংস অনিবার্য।” তিনি আরো বলেছিলেন, “মাওলানা আবদুল জব্বার সাহেব হচ্ছেন মুস্তাজাবুত দাওয়াত- অর্থাৎ তাঁর দোয়া মহান আল্লাহ্র দরবারে কবুল হয়। তিনি যেভাবে দোয়া করেন তার দোআ হুবহু আল্লাহ্ তা’আলা কবুল করেন।”
স্বীয় পীর-মুর্শিদের পবিত্র মুখ নিঃসৃত এসব অমূল্য রতণ বাণী বাস্তবিকই আধ্যাত্মিক জগতে হযরত আল্লামা শাহ্ মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ:) এর উচ্চ মর্যাদার উজ্জ্বল সাক্ষ্য বহন করে। পীর-মুর্শিদের পদাঙ্ক অনুসারী এই মহান অলি শরীয়ত ও তরীকতের প্রচার-প্রসারে নিরলসভাবে আত্মনিয়োগ করেন। দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন সেবাধর্মী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং মানব কল্যাণে নিজের সামগ্রিক শক্তি সামর্থ্য তথা আপন জীবন উৎসর্গ করে গিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ : মুসলিম নারী শিক্ষার উন্নয়ন, থাইল্যান্ড, ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত সেমিনারে যোগদান করেন।
আর্তমানবতার পাশে (ত্রাণ তৎপরতা) : রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের পাশে ১৯৭৮, ১৯৮৮-১৯৮৯
ঘূর্ণি দুর্গতদের মাঝে : ১৯৮৫, ১৯৮৭, ১৯৯১, ১৯৯৪ এবং বন্যা দুর্গতদের মাঝে- ১৯৮৭, ১৯৮৮ সালে ত্রাণ বিতরণ করেন।
তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ : হিন্দু, খ্রিস্টান, চাকমা, ত্রিপুরা, নিগ্রো ১০০ জন প্রায়।
বিদেশ সফর : সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, আরব আমীরাত, ইরাক, পাকিস্তান, ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, আমেরিকা প্রভৃতি দেশ সফর করেন। পবিত্র হজ্ব ও উমরা পালন করেন ৩৩ বার।
শিরক বিদ’আত উচ্ছেদ ও সংস্কার : শাহ্পীর আউলিয়ার মাযার, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম। ছিদ্দিক মিয়ার বলীখেলা, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম। ষাটগম্বুজ মসজিদ ও খানজাহান আলী (রাহ:) এর মাযার, বাগেরহাট।
প্রতিবাদ-প্রতিরোধ : ফিলিস্তিনী মুসলমানদের উপর ইহুদী হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ১৯৯০ সালে সালমান রুশদী ও তসলীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ১৯৮৮ সালে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরের প্রতিবাদ। ইরাকে মার্কিন হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। বাবরি মসিজদ ভাঙ্গনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-১৯৯২। ভারতীয় অভিধানে রাসূলে পাক (সা:) এর শানে অবমাননাকর মন্তব্যের প্রতিবাদ। পাঠ্যপুস্তকে সরকারিভাবে ইসলামি শিক্ষা সংকোচনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ১৯৭৯ সালে রাশিয়া কর্তৃক আফগানিস্তান অগ্রাসনের প্রতিবাদ। ১৯৯৫ সালে রাশিয়া কর্তৃক চেচনিয়ায় অগ্রাসনের প্রতিবাদ।
বৃক্ষরোপণ অভিযান : ১৯৮০, ১৯৯১, ১৯৯২, ১৯৯৭ সালে।
অন্যতম উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা : ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম। ইত্তেহাদুল উম্মাহ বাংলাদেশ। মুসলিম মানবাধিকার সংস্থা।
প্রিয়সখ : অধ্যয়ন, এতিমের লালন পালন, বাগান পরিচর্যা, মৌমাছি, হরিণ ও গবাদিপশু, মুরগী পালন, মৎস্য চাষ।
প্রিয়গ্রন্থ : ‘মসনবী শরীফ’ আল্লামা জালাল উদ্দিন রুমি (রহ:)।
তিনি ছিলেন মহান ও উত্তম চরিত্রের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। প্রথিতযশা আধ্যাত্মিক সাধক, সমাজ সংস্কারক, এতিম, অসহায় ও দুঃস্থ মানবতার সেবক; সর্বোপরি বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক। তিনি একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব, যিনি মানুষের মনের মণিকোঠায় চির ভাস্বর হয়ে আছেন স্বীয় অনুপম বৈশিষ্ট্যে। তাঁর উন্নত চরিত্র, ব্যক্তিত্ব ও আধ্যাত্মিক জীবন এবং যুগোপযোগি লেখনি তাঁকে অমর করে রেখেছে ইতিহাসের পাতায়। ১৯৭১ সালেই পবিত্র হজ্ব থেকে এসে তারই প্রতিষ্ঠিত প্রথম ও বায়তুশ শরফের ইতিহাসে ২য় কক্সবাজার মসজিদ বায়তুশ শরফ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সময়কালে মুসলিম জাহানে যে সব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক, আইনগত, শিক্ষাগত, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পর্কিত সংকট দেখা দিয়েছে তা নিরসনে ইসলামের মহান আদর্শের যুগোপযোগী মূল্যায়ন ও যুগ সমস্যা সমাধানের জন্য গবেষণা পরিচালনার উদ্দেশ্যে ২৮ ডিসেম্বর ১৯৮০ সালে বায়তুশ শরফ ইসলামি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেন। ১৯৭৯ সালে তাঁর নিজ জমিতে প্রতিষ্ঠা করেন বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া এতিমখানা, শাহ্ আখতারিয়া হেফজখানা, বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল (এম.এ) মাদ্রাসা, ধনিয়ালাপাড়া, চট্টগ্রাম।
১৯৭৪ সালে কুমিরাঘোনা আখতরাবাদ মসজিদ বায়তুশ শরফ এবং ১৯৮৮ সালে আখতারুল উলুম মাদ্রাসা, পরে এতিমখানা ও হেফজখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৯ সালে কক্সবাজার জব্বারিয়া ইয়াতিমখানা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন।
১৯ এপ্রিল ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন অরাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী ছাত্র-যুব সংগঠন আন্জুমনে নওজোয়ান বাংলাদেশ।
জুন ১৯৮০ সালে (পবিত্র শবে বরাত রজনীতে) প্রতিষ্ঠা করেন মননশীল ইসলামি পত্রিকা মাসিক দ্বীন দুনিয়া।
২৬ এপ্রিল ১৯৮১ সালে তাঁর উদ্যোগে বায়তুশ শরফ ইসলামি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সুদ-বিহীন ইসলামী ব্যাংকের উপর একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ফলে ১৯৮৩ সালে তাঁর সমন্বিত প্রচেষ্টায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি. প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বায়তুশ শরফ ফাউন্ডেশন ইসলামী ব্যাংকের অন্যতম স্পন্সর। তিনি ছিলেন এ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, গভর্নিং বডির ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আজীবন শরীয়া কাউন্সিলের প্রথম চেয়ারম্যান। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় তার অবদান অনস্বীকার্য।
১৯৮১ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উপর এক জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। যার ফলে ১ জানুয়ারি ১৯৮২ সালে দেশের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল (এম.এ) মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন নিজের গৃহ নির্মাণের জমিতে।
১৫, ১৬ ও ১৭ অক্টোবর ১৯৮৫ সনে বাংলাদেশের প্রখ্যাত, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক ও গবেষকদের নিয়ে ‘বাংলাদেশে ইসলাম’ শীর্ষক ৩ দিনব্যাপী এক জাতীয় সেমিনার চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সেমিনারে ভিন্ন ভিন্ন ১৮টি বিষয়ে প্রবন্ধ পঠিত হয় এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধশতাধিক শিক্ষক, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ, গবেষক অংশগ্রহণ করেন। সেমিনারের প্রবন্ধগুলো দিয়ে জাপান ও শ্রীলঙ্কায় “ওংষধস রহ ইধহমষধফবংয” নামে পুস্তক প্রকাশিত হয়।
১৯৭৯ ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদে চৈত্র পুর্ণিমার ৩ দিনব্যাপী ওরশ ও মেলার সময় সীরাতুন্নবী (সা:) মাহ্ফিল এর আয়োজন করেন। পরবর্তীতে মসজিদ সংলগ্ন জায়গায় মাদ্রাসা ও এতিমখানা কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন।
চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৯২ সালে তাঁরই আহ্বানে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম বাস্তাবায়ন কমিটির প্রথম সভা বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হয়। ফল স্বরূপ ১৯৯৫ সালে আগস্ট মাসে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম উদ্বোধন করেন তিনি। তিনি ছিলেন অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম কম্পিউটার ল্যাবরেটরীর প্রতিষ্ঠাতা এবং উদ্ভোধক ছিলেন তিনি।
১৯৯০ সালে ঢাকা বায়তুশ শরফ দারুশ শেফা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৩ সালে কক্সবাজারে বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া একাডেমী (স্কুল এন্ড কলেজ) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৫ সালে আলেম সমাজের ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন মজলিসুল ওলামা বাংলাদেশ। ৫ অক্টোবর, ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কক্সবাজার বায়তুশ শরফ শিশু হাসপাতাল। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বায়তুশ শরফ চক্ষু হাসপাতাল কক্সবাজার। এ ছাড়াও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, মহিলা কলেজ, এতিমখানা, হাসপাতালসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠান। একই সাথে রচনা ও অনুবাদ করেছেন ২১ খানা গ্রন্থ।
বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের জীবনালেখ্য প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান, আমেরিকা বাইওগ্রাফিকেল ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিতব্য “ইন্টারন্যাশনাল ডাইরেক্টরী অব ডিসটিংগুইশড লিডারশীপ” গ্রন্থে ৮ম সংস্করণ প্রকাশের জন্য এ দেশের সেরা বিশ্বব্যক্তিত্বের বাছাইকৃত কয়েকজনের অন্যতম হিসেবে তার নাম মনোনীত হয়েছে। এ দুর্লভ সম্মান বহনকারী পত্রখানা যখন তাঁর কাছে ৩১ মার্চ ১৯৯৮ সালে পৌঁছে, তার মাত্র ৬ দিন পূর্বেই তিনি জান্নাতবাসী হন। উল্লেখ্য যে, তাঁর মহান জীবন ও কর্ম এর উপর সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ২৬তম খ- বিশ্বকোষে স্থান পেয়েছে।
৬ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে আমেরিকার উদ্দেশ্যে তিনি চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন। ৮-২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থান করে বিভিন্ন দাওয়াতী মাহ্ফিলে আলোচনা অংশগ্রহণ করেন। ২১-২৯ ডিসেম্বর লন্ডনে অবস্থানকালে বিভিন্ন মসজিদ, ইসলামিক সেন্টারসহ বেশ কিছু দাওয়াতী মাহ্ফিল করেন। ইংল্যান্ডের ইসলামিক পার্লামেন্টের সভাপতি নও মুসলিম জনাব ইউসুফ ইসলামের সাথে সাক্ষাত করেন। তাঁকে ইংল্যান্ডের ইয়ং মুসলিম অর্গানাইজেশনের কর্মীবৃন্দ সংবর্ধনা প্রদান করেন। ২৯ ডিসেম্বর ১৯৯১ হতে ১৮ জানুয়ারি ১৯৯২ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফর করেন।
১৩ জানুয়ারি ১৯৯২ রাত দশটায় (বাংলাদেশ সময়) ভয়েস অব আমেরিকা (ঠঙঅ) থেকে তিনিও তাঁর সফর সঙ্গীদের একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। এতে আন্জুমনে ইত্তেহাদের বহুমুখী কার্যক্রম, মানব কল্যাণ ও এ সংগঠনের অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান করেন। এ সাক্ষাৎকারে বায়তুশ শরফের ভক্ত-অনুরক্তসহ বাংলা ভাষাভাষী লক্ষ কোটি শ্রোতা বায়তুশ শরফ আন্জুমনে ইত্তেহাদের সেবাধর্মী কর্মসূচি সম্বন্ধে অবগত হন। উক্ত সফরে লন্ডনে আন্জুমনে ইত্তেহাদের শাখা গঠন করা হয়। লন্ডনের মত স্থানে বৃটিশ সরকারের অধীনে সমাজ কল্যাণমূলক সংঘ হিসেবে আন্জুমনে ইত্তেহাদ রেজিস্ট্রেশন লাভ করে।
৫ জানুয়ারি ১৯৯২ সালে নিউইয়র্কে অবস্থিত চট্টগ্রাম এসোসিয়েশনের পক্ষ হতে তাঁকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। ৪ জানুয়ারি ১৯৯২ সালে নিউইয়র্কে আন্জুমনের শাখা গঠন করা হয়।
এ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তি : ২৫ অক্টোবর ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমাজকল্যাণ ফেডারেশন ও চট্টগ্রাম সমাজ কল্যাণ পরিষদ, সমাজেসেবার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করা হয়।
২০০১ সালে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ইসলামের প্রচার, প্রসার ও মানবকল্যাণে বিশেষ অবদান রাখায় “কারেন্ট নিউজ পদক” মরোণত্তর এ ভূষিত করা হয়।
২৬ ডিসেম্বর ২০০৩ সালে ইসলামি সমাজ কল্যাণ পরিষদ চট্টগ্রাম ‘ইসলামের আলোকে সমাজসেবা ও আধ্যাত্মিক সংস্কারের’ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য মরণোত্তর সংবর্ধনা, নগদ অর্থ ও গোল্ডেনক্রেস্ট প্রদান করা হয়।
২২ অক্টোবর ২০০৪ সালে “বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা সোসাইটি” দ্বীনি ইলম সম্প্রসারণে বিশেষ অবদান রাখার জন্য কুরআন শিক্ষা সোসাইটি এ্যাওয়ার্ড ও নগদ অর্থ প্রদান করা হয়।
২৮ মার্চ ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম এর প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে প্রধান ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে মরণোত্তর সম্মাননা ও গোল্ডেনক্রেস্ট প্রদান করা হয়। যা তৎকালিন মাননীয় রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান এর মাধ্যমে প্রদান করা হয়।
উল্লেখ্য, তাঁর ইন্তেকালের পর প্রদত্ত পুরস্কারসমূহ তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আলহাজ্ব মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল হাই নদ্ভী গ্রহণ করেন।
তাঁর মহিমান্বিত জীবনকে দুইভাগে ভাগ করা যায়-
(১) সমাজ সংস্কার, আত্মমানবতার সেবা ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকা-।
(২) আধ্যাত্মিকতার প্রচার-প্রসার ও তাঁর অমূল্য প্রকাশনা।
তাঁর লেখা ২১টি বইয়ের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো : কোরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে যিকরুল্লাহ্র গুরুত্ব, কোরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে দোয়া মুনাজাতের তত্ত্ব, শরীয়ত ও তরীকতের আদাব, চল্লিশ হাদীস ও চল্লিশ বাণী, এলমে তাসাউফের হাকিকত, আল মুনাব্বেহাত, আল ইহসান, হৃদয়ের টানে মদীনার পানে, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দৃষ্টিতে পীর আউলিয়ার গুরুত্ব, আছরারুল আহকাম, তাফসীরে আউজুবিল্লাহ্ শরীফ প্রভৃতি।
তাঁর চিন্তা-চেতনা ছিল আধুনিক যুগে মানুষের জীবন ব্যবস্থায় উদ্ভূত ধর্মীয়, সামাজিক, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক সমস্যাবলীর মূল্যবোধসম্মত সমাধান খুঁজে বের করা। মানব জাতির প্রতি তাঁর আহ্বান ছিল, “নিজের সুপ্তসত্ত্বাকে বিকশিত কর, সত্যের পথে নিজেকে পরিচালিত কর, কুরআন-সুন্নাহ্র শাশ্বত আলোকে সুখ-শান্তিময় জীবন অর্জন কর, আগামীর জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোল। সর্বোপরি ইহকালের শান্তি ও পরকালে মুক্তি লাভ কর।”
তাঁর কর্মকা-ের সারমর্ম হল- ধর্ম ও কর্মের সমন্বয়ে মানুষকে আদর্শ মানুষে রূপান্তর করা। যুগোপযোগী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা।
মানবদরদী, চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব ও শহীদের পিতা হযরত আল্লামা শাহ্সূফী হযরত মাওলানা আবদুল জব্বার (রহ:) তাঁর অগণিত ভক্তবৃন্দকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ১৯৯৮ সালের ২৫ মার্চ বুধবার সকাল সাড়ে ৭টায় এ নশ্বর পৃথিবী হতে বিদায় নেন। ২৬ মার্চ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম পলোগ্রাউন্ড ময়দানে স্মরণকালের বৃহত্তম জানাযার মধ্য দিয়ে তাঁকে দাফন করা হয় কেন্দ্রীয় মসজিদ বায়তুশ শরফের দক্ষিণ পাশের ফুলবাগানে। ইমামতি করেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল হাই নদ্ভী।
১ মে ১৯৯৮ সাল বিকেল ৪টায় তাঁর স্মরণে আন্জুমনে নওজোয়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে আধুনিক ভাষা ইনিস্টিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণসভা। বাংলাদেশের ইতিহাসে কেবল তাঁর মত মহান সাধক ও সংস্কারক এর আলোচনা সভা ছাড়া আর কোন আলেমের উপর এ বিদ্যাপীঠে ইতোপূর্বে স্মরণসভা হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই।
তিনি যদিও আমাদের চোখের আড়ালে কিন্তু তাঁর রূহ মোবারক বিচরণ করেছে প্রতিটি মুরীদ, ভক্ত-অনুরক্তদের মাঝে। মহান আল্লাহ্ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন এবং তার রূহানী ফয়ুজাত আমাদের মাঝে জারি রাখুন। আমাদেরকে তাঁর আদর্শ, কর্ম, দর্শন অনুসরণে দৃঢ়চিত্ত রাখ, তাঁর প্রদর্শিত কর্মকা-সমূহ বাস্তবায়নে সক্রিয় রাখ। আমীন।
লেখক, হাফেজ ,কলামিস্ট, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী