ডেস্ক নিউজঃ
‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায় ওরা, কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায় … … … … … …। গীতিকার, সুরকার ও গুণীশিল্পী আব্দুল লতিফ। যার জন্ম: ১৯২৭ , মৃত্যু: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৫।
মাটি ও মানুষকে ভালোবাসার প্রেরণার উৎস খ্যাতনামা গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীতশিল্পী আব্দুল লতিফ । তিনি ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত জনপ্রিয় গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ এর প্রথম সুরকার। যদিও তাঁর এ সুর গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
‘কইতো যাহা আমার দাদায়,কইছে তাহা আমার বাবায়এখন, কও দেখি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়। জাগোরে এবার সময় যে আর নাই, আইজো কি তুই বুঝবি নারে বাংলা বিনে গতি নাই।’ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায় ওরা, কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়……।’আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’ ইত্যাদি গানের রচয়িতা।
আবদুল লতিফ সঙ্গীতের নানা শাখায় বিচরণ করেছেন। বাল্যকাল থেকে গ্রামবাংলার জীবনযাপন পদ্ধতি, আচার-অনুষ্ঠান, সঙ্গীতকলার সঙ্গে পরিচিতির ফলে তাঁর নিজের মধ্যে একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লাভ করে। মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত আবদুল লতিফের সঙ্গীতে পরিস্ফুট হয় অসাম্প্রদায়িক লৌকিক গণচেতনা।
বরিশালের রায়পাশা গ্রামে ১৯২৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুল লতিফ। তাঁর পিতার নাম আমিনুদ্দিন, মায়ের নাম আজিমুন্নেসা। উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে কলকাতায় চলে যান। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিলো। ১৬ বছর বয়স থেকে গান গাইতে শুরু করেন। সরাসরি রাজনীতিতে যোগ না দিলেও তিনি রাজনীতি সচেতন ছিলেন। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও তাঁর অংশগ্রহণ ছিলো। তিনি বিভিন্ন ধরণের গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন ও গেয়েছেন। বেশি লিখেছেন পল্লিগীতি, দেশাত্মবোধক গান, গণসংগীত ও আধুনিক গান। আব্দুল লতিফ এর গানগুলিতে পূর্ববাংলার অধিকারবঞ্চিত মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে। তিনি পুথি পাঠেও সুনাম অর্জন করেন। বেতারে তিনি নিয়মিত পুঁথি পাঠ করেতন।
১৯৪৮ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় চলে আসেন এবং পরের মাসে বেতারে নিয়মিত শিল্পী হিসেবে যোগ দেন। তিনি নিয়মিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইতেন এবং ভাষা আন্দোলনে অণুপ্রেরণা যোগাতেন।
১৯৫২ সালে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখা আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটিতে তিনি প্রথম সুরারোপ করেন। পরবর্তীকালে গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ এবং এ সুরটিই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময়ে লেখা তাঁর সবেচেয়ে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত গান- ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’। এ গানটিতে তিনি বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের আবহ ও সুরকে ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুণভাবে। বিখ্যাত এ গানটি পূর্ববাংলার ঐতিহ্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার এক প্রতীকী গানের বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। সঙ্গীতে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আব্দুল লতিফ তাঁর জীবনে অসংখ্য গানে সুরারোপ করেছেন এবং কন্ঠ দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অধিদপ্তরে চাকরি করতেন। এখন পর্যন্ত তাঁর লেখা তিনটি গানের বই পাওয়া গেছে।
১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমী প্রকাশ করে তাঁর লেখা “ভাষার গান দেশের গান” শিরোনামের একটি গ্রন্থ। এদেশের সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে একুশে পদক এবং ২০০২ সালে তাঁকে স্বাধীনতা পদক প্রদান করা হয়।
এছাড়াও বাংলা একাডেমী পদক, শিল্পকলা একাডেমী পদক, ভাষাসৈনিক সম্মাননাসহ বহু সম্মাননা পেয়েছেন।
২০০৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জননন্দিত সঙ্গীতজ্ঞ আব্দুল লতিফ মৃত্যুবরণ করেন।