লেখক:তারিকুল আলম
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট
নোয়াখালী
“Whenever you read a good book, somewhere in the world a door opens to allow in more light.”
পবিত্র কোরআনের প্রথম অবতীর্ণ শব্দই হলো ‘ইকরা’ বা ‘পড়’। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআন শরীফে সুরা আলাক, আয়াত : ১-৩ বলেন, “পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, জমাট রক্তপিণ্ড থেকে ”। মহান আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে সর্বপ্রথম যে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা হলো ‘পড়’। জ্ঞান অর্জনের চাবিকাঠি হচ্ছে বই পড়া, এতে স্রষ্টা আর তার সৃষ্টি সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান বিকাশিত করে। এটা কোনো কাকতালীয় বিষয় নয় যে, ‘কোরআন’ শব্দটাও যে-মূল শব্দ থেকে এসেছে, তার অর্থ পড়া, পুনরাবৃত্তি করা বা আবৃত্তি করা। কাজেই সঠিকভাবে পড়াটাও হতে পারে এক ধরনের বড় ‘ইবাদত’।
বই একদিকে যেমন জ্ঞানের উৎস, অন্যদিকে জ্ঞান সংরক্ষণের প্রাথমিক আধার। জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয় বই পড়ার মাধ্যমে। জ্ঞান দর্শনের প্রধান কাজ হলো ৮টি, তাহলো- (১) অনুধ্যানমূলক কাজ; (২) সমন্বয়মূল কাজ; (৩) বিচারমূলক কাজ; (৪) আদর্শায়নমূলক কাজ; (৫) মূল্যায়নমূলক কাজ; (৬) নির্দেশনামূলক কাজ; (৭) সংগঠনমূলক কাজ; এবং (৮) ব্যক্তিক দৃষ্টিতে সর্বজনীন দৃষ্টিতে রূপায়িত করার কাজ। দেশ ও জাতির উন্নতি এবং সমৃদ্ধির জন্য বই পড়ার মাধ্যমে জ্ঞানের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটাতে হবে। মহামানবদের অমর রচনাবলি ও জীবনী সাধারণের মধ্যে প্রচার করে জাতীয় উন্নতির বিকাশ ত্বরান্বিত করা সম্ভব। কেননা, মনীষীদের চিন্তার সংস্পর্শে এসে মানুষ যাবতীয় সংস্কার ও সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সুউচ্চ ও উন্নত জীবনের অধিকারী হয়, ফলে একটি মর্যাদাশীল জাতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
মূল কথা হচ্ছে, অধিকাংশ মানুষের কাছে বই পড়া আজ এক হারিয়ে যাওয়া শিল্প। বইয়ের সঙ্গে সব ধরনের সংযোগ যেন আজ দুর্বল-ম্রিয়মাণ। বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে, এমন লোকের সংখ্যা বিশ্বে দিন দিন কমে যাচ্ছে। অথচ সভ্যতা জুড়ে দেখা যায়, বই এবং বই পড়াকে কত সম্মান আর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এর স্বকীয়তা এখানেই যে বই ও বই প্রকাশনার সঙ্গে সাধারণ জনগণের ছিল সুশৃঙ্খল সংযোগ। ফ্রান্য রনসেনথাল তার বইতে লিখেছেন, ‘জ্ঞানের ধারণা লাভ করা অনন্য এক সাফল্য। অতীতের সেই সাফল্য ছিল যথাযথ। আর এই সাফল্য অর্জন হয়েছিল অনবরত বইয়ের মধ্যে বুঁদ হয়ে থেকে এবং বৈচিত্রময় রকমারি সব বই থেকে স্বাদ নেওয়ার মাধ্যমে”। অনেকে হয়তো ইন্টারনেটের আবির্ভাব, নিত্য-নতুন যোগাযোগ পণ্য এবং সংক্ষিপ্ত ভাষা ব্যবহারের প্রবণতাকে এজন্য দায়ী করবেন। কথাটা সঠিক; কিন্তু মূল সমস্যা আরও গভীরে। আর সেটার শুরু ইন্টারনেট আবির্ভাবেরও আগে। বইয়ের সঙ্গে সংযোগ হারানো এবং পরিণতিতে অধ্যয়ন ছেড়ে দেওয়া-এধরনের প্রবণতার শুরু আরও আগে; কম করে হলেও ১৮ শতকের দিকে। আর এখনও সেই প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
জীবনে সফলতা অর্জন করতে হলে বেশ কিছু গুণাবলি বা দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে। এমন অনেক সফল ব্যক্তিত্বের উদাহরণ রয়েছে যাঁরা নিজের চেষ্টায় বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছেন। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা, মুনীর চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে সবাই চেনে। তাদের সবার মধ্যে একটি সাধারণ গুণাবলি রয়েছে তাহলো তাঁরা সবাই নিয়মিত বই পড়েন। তাঁদের মধ্যে জ্ঞান এর প্রতি যে অসীম তৃষ্ণা রয়েছে তা মেটানোর জন্যই হচ্ছে বই পড়া। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, তাঁরা সফল হওয়া সত্ত্বেও তাদের জানার প্রতি রয়েছে অসীম আগ্রহ। তাই তাঁদের কাছে বই পড়ার গুরুত্ব কমে যায়নি। কারণ তারা জানেন বই পড়েই হওয়া যায় অনেক গুণাবলির অধিকারী। বই আমাদের ১২টি দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে-
১। মানসিক চাপ হ্রাস করা: -কিছু মানুষ তাদের মানসিক চাপ কমাতে ব্যায়ামে আশ্রয় নেয়, কেউ কেউ আবার খেলাধুলার দ্বারস্থ হয় তাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে। জীবনে এমন কোন মানসিক চাপ নেই সেটি যেই পরিমাণই হোক না কেন, যা একটি ভালো গল্প সমাধান করতে পারে না। বই পড়ার মজা হচ্ছে, এটি মানুষকে মুহূর্তের মধ্যেই কোন এক অজানা জগতে নিয়ে যাবে যা মানুষ কখনো কল্পনাও করেনি। একটি ভালো অনুচ্ছেদ মানুষকে প্রতিদিনের বাস্তবতা থেকে একটু হলেও রেহাই দেবে। এমনিভাবে মানসিক চাপ কমিয়ে দিন শেষে মানসিক প্রশান্তি ফিরিয়ে আনবে।
২। মানসিক উত্তেজনা হ্রাস করা:- বই পড়ার সর্বপ্রথম উপকারিতা হচ্ছে মানসিক উত্তেজনা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, অধ্যয়ন Dementia এবং Alzheimer’s নামের এই রোগ দুটিকে হ্রাস এমনকি প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে।
৩। স্মৃতিশক্তি উন্নত করা:- যখন কেউ একটি বই পড়ে সেখানে দেখবে বিভিন্ন তথ্য দেয়া থাকে যা গল্পের স্বার্থেই মনে রাখতে হয়। যেমন:- বিভিন্ন চরিত্র, ইতিহাস, পটভূমি, গল্পের উদ্দেশ্য, উপ-খণ্ড ইত্যাদি। এসব তথ্য আমাদের কাছে অতিরিক্ত মনে হলেও মস্তিষ্কের অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে সবকিছু মনে রাখার। প্রত্যেকটি নতুন স্মৃতি একটি নতুন Synapse তৈরি করে এবং বিদ্যমান স্মৃতিকে আরও শক্তিশালী করে এবং স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিকে আরও উন্নত করে।
৪। শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি করা:-বই পড়া শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধিতে অনেক বেশি সাহায্য করে। যত বেশি বই পড়বে তত বেশি তোমার শব্দ ভাণ্ডারে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শব্দ যোগ হতে থাকবে। নিজেকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা ও আত্মবিশ্বাস জোগাতেও অনেক সাহায্য করবে। নতুন কোন ভাষা শিখতেও বই পড়ার কোন বিকল্প নেই।
৫। অন্যের থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন:- বই হতে যা পড়া হয় তা মূলত কারও বিশেষ জ্ঞান কিংবা অভিজ্ঞতা থেকেই লেখা। সেই জ্ঞান তোমার সফলতাকে ত্বরান্বিত করবে একটি বিশেষ লক্ষ্যের দিকে, যেহেতু তোমাকে একটি সঠিক পথ অবলম্বন করার উপদেশ দেয়া হবে এবং ভুলগুলো চিহ্নিত করে দেয়া হবে। বিভিন্ন বইয়ে দেখবে লেখক তার জীবনের সফলতা এবং ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করে এবং সেই ব্যর্থতা থেকে উপরে উঠতে থাকে বিভিন্ন উপদেশ।
৬। কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে:-বই মানুষকে এক কল্পনার রাজ্যে নিয়ে যাবে, দেখাবে কোন কিছুই যেন অসম্ভব নয়। কীভাবে আচরণের ভিন্নতায় ফলাফলেরও পরিবর্তন আসে। বই যেন এক বিশাল মাকড়শার জাল, যা সবকিছুকেই এক সূত্রে গেঁথে দেয়, মানুষের জানা বিষয়ের সাথে নতুন আবিষ্কৃত বিষয়কে জোড়া লাগিয়ে নতুন এক উত্তর কিংবা সমাধান বের করা যেন বইয়ের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।
৭। Meditation for your soul:-মানসিক প্রশান্তি পাওয়ার জন্য এক নিরিবিলি জায়গায় কোন এক পছন্দের বই নিয়ে বসতে হবে। সেখানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মুক্ত বাতাস চিন্তাকে যেন আরও প্রসারিত করবে । কিন্তু তা কখনোই লাইব্রেরিতে বসে বসে পড়ার মধ্যে পাওয়া সম্ভব নয়। কিছুক্ষণের বই পড়া সারাদিনের ক্লান্তিকে নিমিষেই দূর করে দিতে পারে।
৮। মনোযোগ বৃদ্ধি করে:- তথ্যপ্রযুক্তির যুগের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে মানুষ যেন প্রযুক্তির গতিই আগে গ্রহণ করেছে। মানুষ এখন যে সমস্যাটির সবচেয়ে বেশি সম্মুখীন হয় তা হল মনোযোগের অভাব। ৫ মিনিটের বিস্তারে একদিকে যেখানে কোন কাজের পরিকল্পনা করা হচ্ছে, আরেকদিকে হয়ত ই-মেইল চেক করা হচ্ছে, আবার সেই সংগে কারো সাথে হয়ত করা হচ্ছে চ্যাট কিংবা ব্যবহার করা হচ্ছে স্মার্টফোন।
৯। যোগাযোগ এর মন্ত্র:-যোগাযোগ আমাদের জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্র যা শুধু বই পড়ার মাধ্যমেই প্রেরণ করা যায়। যারা বই পড়ে তারা খুব সহজেই অন্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। তারা জানে কোন পরিস্থিতিতে কি কথা বলতে হয় এবং কার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়। যারা বই পড়ে না, তারা অনেক বিষয়েই সচেতন নয়। যারা কিছুই জানে না তাদের আসলে অন্যকে বলারও কিছু থাকে না।
১০। Analytical thinking কে উন্নত করে:-বই পড়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে Analytical thinking কে উন্নত করা। অনেকের কাজের ক্ষেত্রে দেখা যায় Analytical thinking খুব দরকার পড়ে, সেই ক্ষেত্রে বই পড়া খুব কাজে লাগতে পারে। মানুষের জীবনেও এমন অনেক পরিস্থিতি তৈরি হয় যেখানে Analytical thinking দিয়েই সেসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়।
১১। আত্মন্নোতিতে সাহায্য করে:- বই পড়া নিজেকে এক উন্নত আমি গঠনে সহয়তা করে। বই পড়ার মাধ্যমেই একজন মানুষ এক নতুন পৃথিবী আবিষ্কার করে। বই পড়ার মধ্য দিয়েই একজন মানুষ তার অন্তর দৃষ্টির একটি সুগঠিত পন্থা এবং ভবিষ্যতের উত্তম কর্ম নির্ণয় করতে সক্ষম হবে।
১২। নতুন বিষয় আবিষ্কার করা:- বই পড়ার মাধ্যমে আমরা নতুন কোন বিষয়, নতুন কোন তথ্য কিংবা কোন সমস্যা সমাধান করা অথবা কোন কিছু অর্জন করার নতুন কোন মাধ্যম আবিষ্কার করা যেতে পারে।
“Reading is to the mind, what exercise is to the body” – এই কথাটির মধ্যেই বই পড়ার গুরুত্ব বোঝা যায়। ব্যায়াম যেমন আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখে তেমনি বই পড়ার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের মনকে সুস্থ এবং প্রফুল্ল রাখতে পারি। আসলে বই পড়ার আনন্দ কখনোই শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়, এটি শুধু অনুভব করা যায় অভিজ্ঞতা দ্বারা। প্রকৃত জ্ঞানের স্পৃহা না থাকলে শিক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তখন পরীক্ষায় পাসটাই বড় হয় এবং পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান সীমাবদ্ধ থাকে। এ কারণেই পরীক্ষায় পাস করা লোকের অভাব নেই আমাদের দেশে; কিন্তু অভাব আছে জ্ঞানী লোকের। সেখানে জ্ঞান নির্বাসিত জীবনযাপন করে। একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে জগতের বুকে অক্ষয় আসন লাভ করতে হলে জ্ঞানের প্রতি তরুণ সমাজকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। সহজলাভ আপাতত সুখের হলেও পরিণামে কল্যাণ বহন করে না। পরীক্ষা পাসের মোহ থেকে মুক্ত না হলে তরুণ সমাজের সামনে কখনোই জ্ঞানের দিগন্ত উন্মোচিত হবে না। আসুন, আবার আমরা বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করি। একটি উত্তম বই আপনার জীবনে পরিবর্তন এনে দিতে পারে। আপনাকে দিতে পারে সুনিবিড় শান্তির জায়গার ঠিকানা।
তথ্যসূত্র:
(i) www.granthagata.com
(ii) www.bbc.com
(iii) www.wikipedia.org