মো. রবিউল হোসেন, স্টাফ রিপোর্টার:- খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার চার ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা উন্নয়নের ছোঁয়া পেলেও বেশ কিছু দূর্গম পাহাড়ি জনপদে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। সরকারের নানামূখী উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নত হলেও সুবিধাবঞ্চিত রয়ে গেছে উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের (৮নং ওয়ার্ড) তিনঘরির পাড়া ও যোগ্যাছোলা ইউনিয়নের দূর্গম পাহাড়ি জনপদ (১নং ওয়ার্ড) গুজাপাড়া, আচালংপাড়া ও বড়টিলা এলাকার ১৮-২০টি পরিবার। এক দিকে যেমন অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা অন্যদিকে রয়েছে অনিরাপদ বাসস্থান ও সুপেয় পানি সংকট।
সোমবার (৭ নভেম্বর) উপজেলার দূর্গম গুজাপাড়া, আচালংপাড়া, বড়টিলা ও চাকমাপাড়ায় গিয়ে দেখা যায় এইসব চিত্র। এলাকাগুলোতে মুসলিম, চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমা সম্প্রদায়ের বেশ কিছু পরিবারের বসবাস। এদের মধ্যে অধিকাংশই পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছে জরাজীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ ঘরে। বাঁশের বেড়া আর শনের চালায় তৈরী অধিকাংশ ঘরের ভেতর থেকে দেখা যায় পুরো আকাশ, মেঝেতে নিজেদের তৈরী পাটি বিছিয়েই ঘুমাতে হয় তাদের। জরাজীর্ণ, ভাঙা, লক্কর-ঝক্কর ঝুপড়ি ঘরে মারাত্মক দুর্ভোগের মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করছে এই পরিবারগুলো। রোদে শুকিয়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করেন ওই ভাঙা ঘরে। বৃষ্টি হলে পানিতে সয়লাব হয়ে যায় কারও কারও ঘরের মেঝে।
উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গ্রামগুলোতে যাতায়াতের সড়কগুলো উঁচুনিচু কাঁচা ও মেঠোপথ হওয়ায় বর্ষার মৌসুমে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয় এলাকাবাসীর। সড়কের মাঝে কোথায় ব্রীজ কিংবা কালভার্ট না থাকায় ঝুঁকি নিয়েই উৎপাদিত কৃষিপণ্য নিয়ে বাঁশের সাকু দিয়ে পারাপার হচ্ছে কৃষকরা। এছাড়াও মুমূর্ষ রোগী কিংবা গর্ভবতী নারীদের জরুরী প্রয়োজনে চিকিৎসা কেন্দ্রে নিতেও পোহাতে হয় চরম ভোগান্তি ! বিভিন্ন সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের কর্মসূচির আওতায় কাঁচা সড়কগুলো যতসামান্য সংস্কার হলেও ইটের সলিং না হওয়ায় অপরিবর্তিত রয়ে গেছে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা।
গুজাপাড়ার হত-দরিদ্র কালেন্দ্র কুমার চাকমা আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের এই ওয়ার্ডটি ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় একটি ওয়ার্ড। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত আমরাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। নেই ভালো থাকার ঘর, নেই রাস্তা, নেই কালভার্ট, নেই একটি স্কুল। অথচ অন্যান্য এলাকা কত উন্নত হয়েছে এই সরকারের আমলেই’।
আচালংপাড়ার অসহায় দেবেন্দ্র ত্রিপুরার স্ত্রী মনপতি ত্রিপুরা বলেন, ‘স্বামী সন্তান নিয়ে বেড়াহীন ভাঙ্গা ঝুপড়ি ঘরেই বসবাস করছি। অর্থাভাবে ভালো একটি ঘর করতে পারছি না। সন্তান দুটি তিন কিলোমিটার দূরে পায়ে হেটে গিয়ে পড়ালেখা করছে। এই ঝুপড়িতে রান্না, খাওয়া ও মেঝেতেই ঘুমাই। বর্ষার সময় অন্যের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়’।
বড়টিলার বাসিন্দা তিন সন্তানের জনক হত-দরিদ্র লক্ষী বিলাস চাকমা বলেন, ‘আমি বয়স্ক ব্যক্তি, পাঁচ সদস্যের সংসারের খরচ জোগাতে কষ্ট হয়। প্রায় সময় অর্ধাহারে থাকি। জরাজীর্ণ এই ঘরটিতে কিশোরী দুই মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন পার করছি। বর্ষার সময় বেশি কষ্ট হয়। সরকার যদি একটি ঘর করে দিতো তাহলে বাকীটা জীবন অন্তত মাথা গোঁজার ঠাঁই হতো’।
প্রবীণ ব্যক্তি সুলতান আহমেদ বলেন, ‘এই এলাকাটি দূর্গম আর আয়তনে বড় হওয়ায় অনেকটাই অবহেলিত। আমি নিজেও ৮ সদস্যের পরিবার নিয়ে অনেক কষ্টে দিনপাত করছি। পাহাড় টিলায় কিছু ফসল উৎপাদন করলেও তা সঠিক বাজারজাত করতে পারিনা। রাস্তাঘাট উন্নত হলে এখানকার মানুষের জীবনমান উন্নত হবে। তাছাড়া যাচাইপূর্বক এই এলাকায় সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর প্রদান করলে অসহায় মানুষগুলো মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য সুমন্ত কান্তি চাকমা বলেন, ‘এই ওয়ার্ডের গুজাপাড়া, আচালংপাড়া, বড়টিলা ও চাকমাপাড়া অত্র উপজেলার সবচেয়ে প্রত্যন্ত জনপদ। হত-দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও বেশি। সে অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ হতে প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধা অপ্রতুল। বিশেষ করে রাস্তাঘাট নির্মাণ ও গৃহহীনদের আশ্রয় (ঘর) প্রদান জরুরী’।
যোগ্যাছোলা ইউপি চেয়ারম্যান ক্যয়জরী মহাজন বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে যারা প্রকৃত অসহায় রয়েছে তাদেরকে যাচাই-বাছাই করে ঘরসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ঐ এলাকায়ও বেশ কয়েকটি সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ও সৌর বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। গ্রামগুলোতে যাতায়াতের সড়রগুলো নির্মাণ করা জরুরী। তবে ইউনিয়ন পরিষদের বরাদ্দে রাস্তা ও কালভার্টগুলো করা সম্ভব নয়, তাই জেলা পরিষদ ও উন্নয়ন বোর্ডের বরাদ্দ প্রয়োজন’।
এদিকে উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের (৮নং ওয়ার্ড) তিনঘরিয়া পাড়ায় গিয়েও দেখা যায়, বেশ কয়েকটি পরিবারের মানবেতর জীবন-যাপনের চিত্র। তার মধ্যে অন্যতম নাসিরাম ত্রিপুরা (৭০)। বছর তিনেক আগে স্ত্রী মারা যাবার পর বেড়াহীন ভাঙ্গা ঘরেই কখনো খেয়ে আবার কখনো না খেয়ে শীত, বর্ষা কিংবা প্রখর রোদে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তিনি। দুই ছেলে থাকা স্বত্তেও কেউই পাশে নেই বৃদ্ধ নাসিরাম ত্রিপুরার।
এ বিষয়ে মানিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রক্তিম চৌধুরী বলেন, ‘প্রত্যন্ত জনপদে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করছে সরকার। এই উপজেলার প্রকৃত অসহায়রা যাতে সকল সুযোগ সুবিধা পায় এ ব্যাপারে গুরুত্ব দিচ্ছে উপজেলা প্রশাসন। চলমান ভিডব্লিবি কর্মসূচীতে এইসব এলাকার নারীদের প্রাধান্য দেওয়া হবে।