মো: নাজমুল হোসেন রনি:
আত্মহত্যা সম্পর্কে মসজিদে মসজিদে আলোচনা(৪ নভেম্বর)কালে নানিয়ারচর থানার ওসি সুজন হালদারের নির্দেশে কর্তব্যরত অফিসার তারেক ও এসআই আরিফুল ইসলাম বলেন, কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের অনুমোদন ছাড়া আত্মহত্যা করত, তাহলে তাকে সাধারণভাবে কবর করতে দেওয়া হতো না। তখন ঐ ব্যক্তির মৃতদেহ তার আপনজনরা সমাহিত করত শহরের বাইরে অবস্হিত অন্য কোনো জায়গায়। পাশাপাশি তার জন্য কোনো স্মৃতিফলকও ব্যবহার করা যেত না। তবে ইউরোপে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মহত্যাকে একটি পাপ হিসেবে গণ্য করে, একে ‘শয়তানের কাজ’ বলে নিন্দা করা হয় ৪৫২ খ্রিস্টাব্দে।
মানুষ আত্মহত্যা করত অন্যের জীবন রক্ষার জন্য, কখনো শোকের কারণে, কেউবা ধর্ষণের জন্য লজ্জা থেকে মুক্তি পেতে। কেউ কেউ নিজের জীবনকে নিজেই শেষ করার এই কাজ করত সামরিক পরাজয়ের মতো অসহিষ্ণু পরিস্হিতি থেকে অব্যাহতি পেতে কিংবা শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভের জন্য। কথা হলো, এখনকার সময়ে আত্মহত্যার কারণ কী একই? সভ্যতায় আমরা অনেক এগিয়েছি। শিল্পবিপ্লবের চতুর্থ পর্যায়ের দ্বারপ্রান্েত এসে আমাদের জীবনধারা ও বোধ একেবারেই আগের মতো নেই। কিন্তু আত্মহত্যা কখনো থামেনি; বরং আজকাল আরো বাড়ছে বলে পত্রিকায় নিয়মিত খবর পাই।
আমাদের সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্রদের মধ্যে বেশি। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ও পারিবারিক মনোমালিন্য সমস্যার কারনে বেশি হচ্ছে । আত্মহত্যা করা ১০১ জনের মধ্যে ৬২ জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একই সময়ে মেডিক্যাল কলেজ ও অনার্স কলেজের ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। রিপোর্ট বলছে, ২০২১ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের চার জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২২ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা সংখ্যায় ২৩। আঁচল ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। দেখা গেছে, ২২ থেকে ২৫ বছর বয়েসিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। এই বয়েসসীমার ৬০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে ১৮ থেকে ২১ বছর বয়েসি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ।
অনেকে ভাবছেন, এসব আত্মহত্যার সঙ্গে করোনা মহামারির যোগসূত্র আছে। ধারণাটি একেবারে অমূলক নয়। করোনাকালে সারা দেশেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই সময়ে আর্থিক টানাপড়েন, লেখাপড়া ও পরীক্ষা নিয়ে হতাশা, পারিবারিক সহিংসতা, অভিমান এসব কারণে আত্মহত্যার ঘটনাগুলো ঘটেছে। কেউ পরিবারের সদস্য বা বন্ধুকে অকালে চলে যেতে দেখেছে, হারিয়েছে চাকরি, নানা কারণে তৈরি হয়েছে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। এসবই আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। যৌন নিপীড়নের শিকার, অবহেলা, কিংবা অতি দারিদ্র্য আত্মহত্যার ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কিত বলা যায়।
সারা বিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা একটি, বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে আত্মহত্যার হার বেড়েছে। এই বৃদ্ধি প্রাথমিকভাবে উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে দেখা যায়। আর আত্মহত্যার সবচেয়ে বড় সংখ্যক দেশ চীন এবং ভারত, মোট অর্ধেকেরও বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কিশোর-কিশোরী আর যাদের বয়েস পঁয়ত্রিশ বছরের নিচে, তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। নারীদের তুলনায় পুরুষদের আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। একই ভাবে পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা নারীদের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ। তথ্য আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থার মতোই বলা যায়।
সাধারণত বলা হয়ে থাকে, আত্মহত্যার সঙ্গে মানসিক অসুখের বেশির ভাগ সময়ই একটা সম্পর্ক থাকে। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দুরাবস্হা আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায় এটাই কিন্তু স্বাভাবিক। একজন মানুষ তখনই আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটায়, যখন সে কোনো কারণে হতাশ হয়, ব্যর্থ হয় কিংবা জীবনের আনন্দ হারিয়ে ফেলে। এসবের ফলে তার মধ্যে কাজ করে বিষণ্নতা আর উদ্বিগ্নতা। কখনো কখনো জীবনের কোনো পর্যায়ে এসে কেউ মনে করে, সে আর সফল হতে পারবে না, এমনকি সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা আর তার নেই। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অন্যদের বোঝা হওয়ার অনুভূতি জন্মে অনেক সময়। একজন তরুণ শিক্ষার্থী যে স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠে, তা যখন মুখ থুবড়ে পড়ে তখন সে হতাশ হয়। সে মনে করতে থাকে, তাকে দিয়ে কিছু হবে না বা সমাজে সে ছোট মনে করতে থাকে নিজেকে। তখন সে আর আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এভাবেই সে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে।
তরুণদের আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখন অনলাইনভিত্তিক মিডিয়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ইন্টারনেটভিত্তিক নানা ভিডিও বা ব্লগে আত্মহত্যার বিবরণটির সঙ্গে এই কাজটির বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করায় কেউ কেউ। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুনরাবৃত্তিমূলক কভারেজের কারণে। এভাবে কখনো কখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টিকে যৌক্তিক বলে আত্মহত্যার প্রশংসা বা রোমান্টিসাইজ করা হয়। আবার সংবাদ মাধ্যমে বা ভিডিওতে যখন একটি নির্দিষ্ট উপায় কী করে নিজেকে হত্যা করা যায় তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়, তখন এটির প্রবণতা বাড়তে পারে। এসব ঝুঁকি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বেশি।
লকডাউনে দীর্ঘ সময় ঘরে বসে থাকা, সেশনজটে পড়ে পিছিয়ে যাওয়া, চাকরি পাওয়ার অনিশ্চয়তা, পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা তৈরি হওয়া এসব কারণে বিষণ্নতা তৈরি হয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। আর এই বিষণ্নতাই অনেককে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করছে। পাশাপাশি বন্ধু, আত্মীয়, পরিবারের সদস্যদের অবিবেচকের মতো ব্যবহার, বাবা-মায়ের প্রত্যাশা মেটাতে না পারার হতাশা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের নানা অর্জনের খবরের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশার হার বাড়ছে বলা যায়। আর এসবই আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলছে কাউকে কাউকে। অথচ আমরা জানি, আত্মহত্যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আসলে প্রতিরোধযোগ্য। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশে তেমন কোনো ব্যবস্হা নেই বললেই চলে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্হা করতে ।আমরা যে যার দিক দিয়ে সমাজ বা পারিবারিক হোক বা গ্রুপ ও ধর্মীয় ভিত্তিক প্রচারের মাধ্যমে আত্মহত্যা কে না বলতে হবে। এসময় নানিয়ারচর ইসলামপুরের দুইটি মসজিদে বিশদভাবে আত্মহত্যা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।