রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন এলাকায় গত জুনে ১ হাজার ৬৪৩টি নির্মাণাধীন ভবন পরিদর্শন করেছেন সংস্থাটির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৫টি ভবনেই কোনো না কোনো ধরনের বিচ্যুতি পাওয়া গেছে।
এ অবস্থায় এখন থেকে ১০ তলার বেশি উঁচু ভবন নির্মাণের সময় তা রাজউকের চেয়ারম্যানসহ অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। উদ্দেশ্য—যাতে নিয়ম মেনে ভবন তৈরি হয়। তবে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও ফলপ্রসূ হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজউক থেকে নকশার অনুমোদন নিয়ে ভবন নির্মাণের সময় তা না মানার জন্য মালিকদের পাশাপাশি সংস্থাটির (রাজউক) মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দায়ী করে আসছেন নগরবিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, রাজউকের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা সততার সঙ্গে কাজ করলে নকশার বিচ্যুতিপূর্ণ ভবনের হার অনেকাংশেই কমে আসত।
রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, নিয়ম মেনে ভবন যাতে হয়, সে জন্য তাঁরা সম্প্রতি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ২০ তলার বেশি নির্মাণাধীন ভবন রাজউকের চেয়ারম্যান পরিদর্শন করবেন। ১৪ তলার বেশি উঁচু ভবন পরিদর্শন করবেন রাজউকের সদস্যরা। আর ১০ তলার বেশি উঁচু ভবন রাজউকের পরিচালক পরিদর্শন করবেন।
আনিছুর রহমান মিঞা আরও বলেন, ভবন নির্মাণের শুরুতে ও গ্রাউন্ড ফ্লোর (নিচতলা) নির্মাণের সময় মোট দুই দফায় রাজউক চেয়ারম্যান নিজে পরিদর্শন করবেন। বিষয়টি ইতিমধ্যে রাজউকের পরিকল্পনা বিভাগকে জানানো হয়েছে। কখন-কোন ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হবে, তা লিখিতভাবে চেয়ারম্যানকে জানাতে বলা হয়েছে।
বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়:
সিদ্ধান্তটিকে সম্পর্কে নগর-পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির উদ্দেশ্যে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে সিদ্ধান্তটি একদিক থেকে ভালো। কিন্তু ভবন পরিদর্শনের জন্য রাজউকের চেয়ারম্যান কতটা সময় পাবেন, সিদ্ধান্তটি কতটা কার্যকর হয়, তা দেখতে হবে।
আকতার মাহমুদ বলেন, রাজউক এলাকায় সবচেয়ে বেশি নির্মিত হয় ৬ থেকে ৭ তলা ভবন। ২০ তলার ওপর ভবনের সংখ্যা খুবই কম। তাই শুধু সুউচ্চ ভবন নয়, অন্যান্য ভবনও দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে রাজউকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিদর্শনে যেতে পারেন।
ভবন পরিদর্শনে গিয়ে কোনো ব্যত্যয় পেলে শুধু ভবনমালিকই নন, রাজউকের যে ইমারত পরিদর্শক পরিদর্শনের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁকেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে বলে মত দেন আকতার মাহমুদ।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, পরিদর্শনে নকশার বিচ্যুতি পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট ভবনমালিককে রাজউকের পক্ষ থেকে নোটিশ দেওয়া হয়। এতে সমাধান না হলে উচ্ছেদ অভিযানে যায় রাজউক। তবে রাজউকের সংশ্লিষ্ট মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
বিচ্যুতির তুলনায় উচ্ছেদ কম:
রাজউকের ২০২০-২১ অর্থবছরের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোট ১৫ হাজার ৯৯৩টি ভবন পরিদর্শন করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০৪টি ভবনে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। অর্থাৎ বিচ্যুতির তুলনায় উচ্ছেদের সংখ্যা কম।
বিচ্যুতির তুলনায় উচ্ছেদের সংখ্যা কম কেন, জানতে চাইলে রাজউকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মামলা করা হয় এবং একপর্যায়ে রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শিথিলতার কারণে বিচ্যুতি ঘটিয়ে নির্মিত ভবনের বিরুদ্ধে আর দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
রাজউকের এই কর্মকর্তার মতে, নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মিত সব ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। কারণ, রাজউক অনুমোদিত ভবনের চেয়ে কোনো ধরনের অনুমোদন নেই, এমন ভবনের সংখ্যাই বেশি।
অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যা কত:
ঢাকায় মোট কত ভবন আছে, অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যা কত, তার কোনো সঠিক তথ্য রাজউকে পাওয়া যায়নি।
তবে রাজউকের প্রক্রিয়াধীন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) ভৌত জরিপ অনুযায়ী, সংস্থার আওতাধীন ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় (ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, সভার উপজেলা, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের আংশিক) প্রায় ২১ লাখ ৪৫ হাজার স্থাপনা আছে।
জরিপে দেখা যায়, রাজউকের এলাকায় ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৯৫ হাজার নতুন স্থাপনা গড়ে উঠেছে। কিন্তু এ সময়ে রাজউক থেকে প্রতিবছর গড়ে ৪ হাজার ১৭৫টি স্থাপনার অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। সে হিসাবে এই ১০ বছরে নির্মিত স্থাপনার ৯৫ দশমিক ৩৬ শতাংশই অবৈধ।
ড্যাপ ছাড়াও ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত একটি পৃথক জরিপ করে রাজউক। দোতলার বেশি ২ লাখ ৪ হাজার ১০৬টি ভবনের ওপর জরিপটি করা হয়।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও পল্লবী এলাকার ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভবন; রামপুরা, মতিঝিল ও খিলগাঁও এলাকার প্রায় ৯৭ শতাংশ ভবন এবং ধানমন্ডি এলাকার প্রায় ৮৯ শতাংশ ভবন নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, ভবন নির্মাণের সংখ্যা ও রাজউক থেকে অনুমোদন নেওয়ার হার এখনো আগের মতোই আছে।
সংস্থাটির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ হাজার ৯৩২টি ভবনের নির্মাণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
রাজউক এলাকার বেশির ভাগ বহুতল ভবন (১০ তলার ওপর) হয়েছে এক থেকে দুই দশকের মধ্যে। এ ধরনের ভবনেও নকশার ব্যত্যয় আছে।
২০১৮ সালের মার্চে রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পর রাজউক আওতাধীন এলাকার বহুতল ভবনের ওপর পরিচালিত জরিপে এ তথ্যের প্রমাণ পাওয়া গেছে।