বাপ্পা চৌধুরী : দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক হত্যাকান্ড নতুন কিছু নয়। ১৯ শতকের মধ্যভাগ থেকে এ ধরনের হত্যাকান্ড সংগঠিত হওয়া শুরু হয়। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ঘটেছে এমনি এক নারকীয় হত্যাকান্ড।
জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে শুক্রবার ৮ জুলাই ২০২২ সালে বন্দুকধারীর গুলিতে গুরুতর আহত হওয়ার পর মারা গেছেন। ইতিহাসের দিকে তাকালে এরকম অনেক নজির দেখা যায়।
মোহনদাস করমচাদ গান্ধী : ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মোহনদাস করমচাদ গান্ধী তথা মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ শাসন পরবর্তী দক্ষিণ এশিয়ায় ভূমিতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের গোড়াপত্তন ঘটে। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী ব্যক্তি এবং ভারতের জাতির জনক। তার হত্যাকারী ছিলেন নাথুরাম গডসে। যিনি উগ্র হিন্দুত্ববাদী কর্মকান্ডের সাথে দীর্ঘদিন জড়িত ছিলেন। তার ধারণা ছিল মহাত্মা গান্ধী ভারত বিভাজনের সময় মুসলমানের পক্ষে কাজ করেছেন। সেই প্রেক্ষাপটে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেন। এই হত্যাকাণ্ডে পুরো জাতি শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। গান্ধীজির হত্যার বিচার কার্যকর হয়েছিল ১৯৪৯ সালে।
লিয়াকত আলি খান : দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক হত্যাকান্ডটি ঘটে ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে। সেখানে এক জনসভায় ভাষণ দেয়ার পূর্বে আততায়ীর গুলিতে মারা যান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান। যিনি পাকিস্তান আন্দোলন এবং রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। তাকে হত্যার কারণ জানা যায়নি।
সলোমান বন্দরনায়েক : ১৯৫৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী সলোমান বন্দরনায়েক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
শেখ মুজিবুর রহমান : দক্ষিণ এশিয়া তথা মানব ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংসতম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডটি ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। এ দিন বাঙালির জাতির পিতা, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। শুধু তার পরিবারের সদস্যদেরকেই নয় বরং তার আত্মীয়দেরকেও হত্যা করা হয়েছিল। তার বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহকর্মীদেরও জেলের ভিতর হত্যা করা হয়েছিল। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাইকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে।
জুলফিকার আলী ভুট্টো : ১৯৭৯ সালে সামরিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর। জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ডকে সামরিক শাসক জিয়াউল হকের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিযোগ রয়েছে। তার মৃত্যুর পরে তার কন্যা বেনজির ভূট্টো পিপিপি এর প্রধান হন এবং ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন।
ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী: তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর একমাত্র কন্যা। যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন। ভারতের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালনের গৃহীত পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় নিজ দেহরক্ষীর গুলিতে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর নিহত হন তিনি। এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছিল ১৯৮৯ সালের ৬ জানুয়ারি।
জিয়াউল হক : ১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়াউল হক মারা যান বিমান দুর্ঘটনায়। যদিও অনেকেই এটিকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে ধারণা করেন। তার জানাজা এবং দাফন কার্য রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানেই হয়েছিল।
রাজিব গান্ধী : ১৯৯১ সালের ২১ মে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে রাজিব গান্ধী তামিলনাড়ু রাজ্যে এক আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন। শ্রীলংকার এলটিটিই প্রথমে তার হত্যার দায় অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করে নেয়। তার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে গৃহীত পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তার হত্যার পাঁচ বছর আগের মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর এক রিপোর্টে তাকে হত্যার পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করে। এ হত্যাকাণ্ডের বিচারও খুব দ্রুত হয়েছিল।
বেনজির ভুট্টো : তিনি নিহত হন ২০০৭ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে এক রাজনৈতিক জনসভায় আত্মঘাতী বোমা হামলার শিকার হয়ে। যেখানে ৫৬ বছর আগে নিহত হয়েছিলেন লিয়াকত আলি খান।
শিনজো আবে : সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে শুক্রবার ৮ জুলাই ২০২২ সালে বন্দুকধারীর গুলিতে গুরুতর আহত হওয়ার পর মারা গেছেন। পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে ৪১ বছর বয়সী একজন সন্দেহভাজন পুরুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একটি বিশিষ্ট রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণকারী, শিনজো আবে । তিনি দেশটির দীর্ঘতম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। অর্থনৈতিক অস্থিরতার পর জাপানে কিছুটা স্থিতিশীলতা আনার কৃতিত্ব দেওয়ার সময়, আবে তার জাতীয়তাবাদী বক্তব্যের মাধ্যমে প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীন – সহ অনেক জাপানি -কে ক্ষুব্ধ করেছিলেন এবং দেশের শান্তিবাদী সংবিধান সংশোধন করার আহ্বান জানান। তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুপ্রতিম ও সহযোগী ছিলেন। ইতিহাসে এরকম অনেক রাষ্ট্রপ্রধান রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হয়ে প্রাণ ত্যাগ করেন। পৃথিবীর বুকে উনাদের নাম বিভিন্ন কারণে উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।