পাহাড়ের মাঝখানে আয়তাকার একটি মাঠ। মাঠের মধ্যভাগে ক্রিকেট খেলার ২২ গজের পিচ। আবার দুই প্রান্তে দুইটি গোলপোস্ট। দেখেই বোঝা গেলো ক্রিকেট ও ফুটবল খেলা হয় মাঠটিতে। মাঠটির পূর্বপাশে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার একটি ছেলে বল শূন্যে ডিবলিং করছে। অনেকেই তার দিকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। তার পড়নে বির্বণ একটি জার্সি, পায়ে পুরোনো বুট জুতা। কাছে যেতেই কয়েকজন বলাবলি করছিল, গতকাল বাসিং একটি গোল করেছে ও একটি এসিস্ট। তার আগের ম্যাচে করেছে হ্যাট্টিক।
একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম কে ছেলেটি ! আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল বাসিংমং মারমা। ডাক নাম বাসিং । রাঙামাটি জেলার উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত রাজস্থলী উপজেলার বাংগাল হালিয়া এলাকায় জন্ম গ্রহণ করে বাসিংমং। দরিদ্র পরিবার। বাবা অংসেপ্রু মারমা মা ইউচিং মারমা। দুই ভাই বোনের পরিবার। নুন আনতে পান্তা ফুরাতো পরিবারের। এসব কথা জানালো বাসিংমং’ এর এলাকার এক সহপাঠী। পড়াশোনায় বেশিদূর না এগুলেও ফুটবল তার ধ্যান জ্ঞান। গ্রীষ্মের খরোরোদ্রতাপ, বর্ষা অঝোর বারিধারা, শীতের হিমেল হাওয়া কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে কঠোর অনুশীলন করে বাসিংমং।
অর্ধযুগ বছর আগেও ফেইসবুকে শহরের স্টেডিয়াম ও দর্শক দেখে পাহাড়ের অজপাড়া গাঁ থেকে বেড়ে উঠা বাসিংমং ভাবতো বুট জুতা, জার্সি ছাড়া শহরের স্টেডিয়ামে বড় বড় খেলোড়ারদের সাথে কেমনে নিজেকে প্রমাণ করবে! নানা দুঃচিন্তা তাকে দমানোর চেষ্টা করতো । কিন্তু সে থেমে থাকেনি কারণ তার ছিলো অদম্য প্রতিভা ও আগ্রহ। ছোট বেলা থেকে পাহাড়ী জনপদের সাথে বেড়ে উঠায় সে জানতো কিভাবে পাহাড়সম বাধা-বিপত্তি পদদলিত করতে হয়।
নানা প্রতিবন্ধকতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলের সীমানা অতিক্রম করে বিভিন্ন ক্লাব পর্যায়ে তার অবস্থান ছিল শীর্ষে। কথায় কথায় জানা গেলো বাসিং রাইট উইংঙ্গার ও স্ট্রাইকার পজিশনে খেলে। অল্প সময়ে ২০১৬ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে চট্টগ্রাম রাইজিং স্টার ক্লাবে খেলার সুযোগ পায় বাসিং। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগ বি.জি প্রেস ক্লাব ঢাকায় খেলার সুযোগ পায়। রাঙামাটি জেলা দলেও জায়গা করে নেয় তরুণ উদীয়মান এই ফুটবলার। উইন স্টার ক্লাব রাঙামাটি প্রথম বিভাগ টূর্ণামেন্টে সে দুর্দান্ত পারর্ফম করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন ক্লাবে খেলার সুয়োগ পেয়েছিলো। দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে ফুটবল লিগ ও বড় টুর্ণামেন্টের খেলেছে পাহাড়ের বাসিংমং । মহাখালী একাদশের হয়ে ঢাকার ১ম বিভাগ লিগ এবং বি.জি.প্রস এস এন্ড আর সি ক্লাবে হয়ে ঢাকার ২য় বিভাগ লিগ খেলেছে। চট্টগ্রামের রাইজিং স্টারে ক্লাবের হয়ে ১ম বিভাগ লিগ এবং রাংগুনিয়া ফুটবল একাদশের হয়ে ২য় বিভাগে খেলেছে। সে বর্তমানে রাঙামাটি জেলা দলের উইংঙ্গার ও স্ট্রাইকার পজিশনে খেলেছে। স্থানীয় পযায়ে রাজস্থলী উপজেলায় কাপ্তাই ২৩ ইস্ট বেঙ্গল এর উদ্যোগে জোন কমান্ডার কাপে তার অনবদ্য অবদানেই বাঙ্গালহালিয়া হ্যাডম্যান পাড়া ফুটবল দল বিজয়ী হয়েছিল।
”আমি ফুটবল কে নিজের জীবনের চেয়েও অনেক বেশী ভালবাসি। যেদিন থেকে হাটঁতে শিখেছি সেই দিন থেকেই ফুটবল আমার ধ্যান-জ্ঞান। এলাকার বড় ভাইদের কাছ থেকে পাওয়া মানসিক শক্তিই আমার অনুপ্রেরণা।সুযোগ পেলে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে খেলতে চাই। এরপর প্রিমিয়ার লিগে নিজেকে প্রমাণ করে লাল সবুজের জার্সিটা বুকে নিতে চাই। জার্সি গায়ে বিশ্বের দরবারে দেশের নাম উজ্জ্বল করতে চান সম্ভাবনাময় তরুণ ফুটলার বাসিংমং মারমা। ব্রাজিল দলকে সমর্থন করেন বাসিংমং। নেইমার জুনিয়র তার প্রিয় খেলোড়ার।
সাবেক চট্টগ্রাম মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ফুটবল খেলোড়ার মংঞো মারমা মুঠো ফোনে বলেন, বাসিংমং মারমা খুবই ছোট থেকেই ফুটবল খেলে আসছে, তার এই ধারাবাহিকতার ফলে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায় খেলার সুযোগ হয়েছে, তাই সরকার ও বাফুফে যদি বাসিং দের মত মফস্বলের তরুণ ফুটবলারদের নজরে আনতেন তাহলে বাংলাদেশের ফুটবল খেলার মান বিশ্বের দরবারে আরো এগিয়ে যাবেন বলে তিনি মনে করেন। এতো ভালো পর্যায়ে খেলার পরও এই ফুটবলার এখনো পরে আছে গ্রামের মাঠে এ প্রশ্নের উত্তর তিনি খুজেঁ পান না! তিনি জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও স্থানীয় জন প্রতিনিধিদের প্রতি দৃষ্টি আর্কষণ করে বলেন সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল খেলার সুযোগ করে দিলে বাসিং নিজেকে তুলে ধরবে।
বাংগাল হালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যন আদুমং মারমা জানান, বাসিংমং খুব ভালো ফুটবল খেলে। তার পায়ে জাদু আছে। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে মন থেকে চেষ্টা করবো এ ছেলেটার জন্য কিছু করার।
এ ব্যাপারে রাঙামাটি জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক জুয়েল চাকমা বলেন, বাংগাল হালিয়ায় ছেলে বাসিংমং খুব ভালো ফুটবল খেলে। তার মধ্যে প্রতিভা রয়েছে। সে জেলা ফুটবল দলে বেশ সফলতা দেখিয়েছে। তার প্রতি আমাদের সবার সুনজর আছে।
দূর্ভাগ্য আর বাসিংমং যেন ছায়াসঙ্গী। প্রিয়িমার ডিভিশনের কাছাকাছি গিয়ে খেলা হলো না। এরপর করোনার করাল থাবা। সর্বশেষ ২৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতীয় চ্যাম্পিয়ন্সশীপ প্লেট পর্বের বান্দরবন ও রাঙামাটি জেলার ফাইনাল খেলায় গুরুতর আহত হন বাসিংমং। বাম পায়ের হাড় ভেঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিয়েছেন। রাঙামাটি জেলা ক্রীড়া সংস্থা চিকিৎসার কিছুটা খরচ বহন করেছে। লম্বা সময় বিছানায় থাকার পর বাসিংমং’র সুস্থ হয়েছেন। অনুশীলনও শুরু করেছেন । বাসিংমং তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি হওয়ায় সবসময় চিন্তায় থাকেন । খেলাধুলার পাশাপাশি সরকারী বেসরকারী নানা প্রজেক্টে খন্ডকালীন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন এ মেধাবী ফুটবলার।