চট্টগ্রাম সরকারী কলেজের বিশাল মাঠটি নগরবাসীর কাছে প্যারেড মাঠ হিসেবেই বেশি পরিচিত। নগরীর সিরাজউদ্দৌলা রোড ও কলেজ রোডের মধ্যবর্তী স্থানে মাঠটি অবস্থিত। বছরের প্রায় সবসময়ই মাঠে খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত সময় পাড় করে থাকে তরুণ খেলোড়াররা। ফযরের নামাযের পর থেকেই মুখরিত থাকে মাঠটির প্রতিটি কর্ণার যা চলতে থাকে এশারের নামায পর্যন্ত। মাঠের পশ্চিম পাশে শীত আসলেই মধ্য বয়সী এক দল লোক হ্যান্ডবল খেলায় মেতে উঠে। সবচেয়ে দৃষ্টিকাড়ে মাঠের পূর্বপাশে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে ২০ থেকে ৪০ উর্ধ্ব বয়সী ছোট গোলপোস্টে ফুটবল খেলা দেখে। বর্ষাকালে এ মাঠটি রাজত্ব করে বেড়ায় বিভিন্ন বয়সী ফুটবল খেলোড়াররা ।
তবে বর্ষাকাল ব্যতীত বছরের অন্যান্য সময় মাঠটিতে ক্রিকেট খেলোড়োরদের আধিপত্য থাকে। ২০১৩ সালে মাঠের চারপাশে সংস্কারের সময় নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তমঞ্চ। মাঠের চারপাশে বানানো হয়েছে “ওয়ার্ক ওয়ে”। বৃক্ষরোপণ ও নানা কারুকার্য করে প্যারেড মাঠের শোভাবর্ধন করা হয়েছে।
ওয়ার্ক ওয়েতে ভোর থেকে নানা পেশার ও ভিন্ন বয়সের লোকজন হাটাঁহাটিঁ করে। সন্ধ্যার পর থেকেই আড্ডা জমতে থাকে নানা শ্রেণীর মানষের যা চলে প্রায় নয়টা পর্যন্ত। নগরের একাংশের বাসিন্দাদের কাছে বুকভরে শ্বাস নেওয়ার এক টুকরো মুক্তাঙ্গণ প্যারেড মাঠটি।
মূলত চকবাজার, চন্দনপুরা, কাপাসগোলা, শুলকবহর, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও ও বাকলিয়ার বাসিন্দারা বেশি ছুটে আসেন । প্রতিদিন এখানে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ক্রিকেট, ফুটবল ও হ্যান্ডবল খেলেন অন্তত ১০ থেকে ১৫টি দল।
মাঠে প্রবেশ করে দেখা যায়, ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মাঠে ফুটবল খেলছে চারটি গ্রুপ। পাচঁলাইশ থেকে ফুটবল খেলতে আসা স্কুল শিক্ষার্থী সুজয় দাশ বলেন, ‘বাসার আশপাশে খেলাধুলার কোনো মাঠ নেই। তাই বন্ধুদের নিয়ে খেলতে এখানে চলে আসি। মাঠে যতটুকু জায়গা পাই, ততটুকুতে খেলাধুলা করি। অনেকগুলো দল এক সঙ্গে মাঠে খেলার কারণে ভালো করে খেলাধুলা করা যায় না। এ এলাকায় আর কোনো বড় মাঠ না থাকায় সবাই একসাথে খেলাধ‚লা করি কোনোরকমে।
জগিং করতে আসা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ছাত্র সীমান্ত তালুকদার জানান, এখানে অনেক লোক হাঁটতে আসেন। কখনও তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটি, কখনও নিজেই গান শুনতে শুনতে হাঁটি। নাগরিকদের জন্য যে খোলা জায়গার দরকার তা আমাদের নগর উন্নয়নের দায়িত্বে থাকা কর্তারা বুঝেন না। তারা খালি জায়গায় বড় বড় ফ্লাইওভার নির্মাণ করেন। কিন্তু কোনো মাঠ কিংবা উদ্যান তৈরি করেন না। বাসার পাশে এ ধরনের খোলা জায়গা থাকায় হাঁটার জন্য এতদূর আসতে হয়েছে ।
চকবাজারের জেলে পাড়া থেকে ফুটবল খেলতে আসা বাবু দাস বলেন, ‘যেখানে থাকি সেখানে কোনো মাঠ না থাকায় প্যারেড মাঠে খেলতে চলে আসি। অনেকগুলো দল এক সঙ্গে খেলি। তবে এভাবে খেলাধূলা খেলা খুব বেশি কষ্টকর।
বৃষ্টি থামার সাথে সাথে মুক্তমঞ্চে দেখা মিলে আড্ডাবাজ দলের সদস্যদের। হরেকরকম চিন্তা ভাবনা ও বিষয় নিয়ে আড্ডাবাজিতে মেতে উঠেছে। এমনই একজন আড্ডা দিচ্ছিলেন মো. শহীদ নামে একজন। তিনি পেশায় স্কুল শিক্ষক।
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরে প্রায় ৭৫ লাখ লোক বসবাস করে। সেই তুলনায় প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য কোনো খোলা জায়গা নেই। প্রতিদিন প্যারেড মাঠে চলে আসি। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করি। আড্ডা দিই। খুব ভালো লাগে।
ডায়াবেটিস সারাতে প্রতিদিন প্যারেড মাঠে হাঁটতে আসা আবদুর রহমান বলেন, ‘ফুটপাতগুলো থাকে দোকানদারদের দখলে। সেখানে নিয়মিত পথচারীরা হাঁটতে পারেন না, আমার মতো অসুস্থ মানুষ হাঁটবে কী করে। তাই প্যারেড মাঠে চলে আসি। এখানেও লোকজনের এত ভিড় হয়, ভালো করে হাঁটাও যায় না।
প্যারেড মাঠ থেকে বের হওয়ার সময় দেখা হয় একদল পঞ্চাশ উর্ধ্ব লোকের সাথে। প্রতিদিন বিকেল ৫ টার পর সবাই মিলে চান্দগাঁ আবাসিকের এ বুক থেকে হেঁটে প্যারেড ময়দানে চলে আসে। সবাই মিলে কথা বলতে বলতে প্রায় ২ ঘন্টা হাঁটেন উনারা।
চট্টগ্রাম কলেজের মনোবিজ্ঞান অনুষদের ছাত্র মো. সৈয়দ হতাশার সুরে জানান , মাঠের চরাপাশে ছোট্ট চায়ের দোকান গুলোতে সবার জন্য কমম‚ল্যে খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও মাঠের বাইরে চারপাশে বসে সিগারেট ও বিভিন্ন নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন প্যারেড মাঠের সুন্দর পরিবেশে কিছুটা বিঘ্ন ঘটায়। পাশাপাশি কিছু বখাটে ছেলে জগিং করতে আসা মহিলাদের উদ্দেশ্যে বাজে মন্তব্য করে। এসব বিষয়ে কলেজ কৃর্তপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট থানার দৃষ্টি আর্কষণ করেন তরুণ মনোবিজ্ঞানের এ ছাত্র।
উল্লেখ্য ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রাম কলেজের উত্তর পাশের বিশাল খালি ময়দানটিতে গোরা বাহিনী প্যারেড বা কুচকাওয়াজ করত। পরবর্তী সময়ে মাঠটি ‘প্যারেড ময়দান’ নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে। ২০১৩ সালে মাঠটিকে ঘিরে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ওয়ার্ক ওয়ে, লোহার বেড়াসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। মাঠটি প্রতিদিন ভোর থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। তবে মাঠে কোনো সভা, সমাবেশ, ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে চাইলে চট্টগ্রাম কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়।
মাঠের পরিচর্যা ও সংস্কারের বিষয়ে ১৬ নং চকবাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ন‚র মোস্তাফা টিনু জানান, আমি নির্বাচিত হওয়ার পর চিন্তা করেছি এ মাঠটি অন্তত বছরে একবার সংস্কার করার ব্যাপারে সহযৌগিতা করবো।
ক্রিকেট প্রশিক্ষক আরিফ সালেহ জানান, এই প্যারেড মাঠেও এক সময় ক্রিকেট, ফুটবলসহ বিভিন্ন ধরনের টুর্নামেন্ট হতো। অনেক জাতীয় ক্রিকেটার এই মাঠে এক সময় খেলেছেন। বেশ কয়েক বছর আগে অযত্ন আর অবহেলায় এ মাঠটিও খেলার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছিলো কিন্তু এখন মাঠের অবস্থা আগের চাইতে অনেক ভালো।
চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোজাহেদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সার্বিকভাবে মাঠের অবস্থা ‘ভালো’ আছে দাবি করে তিনি বলেন, “এই মাঠে অনেকেই খেলতে আসে কেউ ফুটবল, কেউ ক্রিকেট। ফলে গোলপোস্ট, ক্রিকেট স্ট্যাম্প বসানোর কারণে এখানে-ওখানে কিছু গর্ত আছে, সেসব সংস্কার করা হয়েছে”।
মাঠের পরিবেশের ব্যাপারে জানতে চাইলে, চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রলীগ সভাপতি সুভাষ মল্লিক সুবজ বলেন , ক্যাম্পাস ও প্যারেড মাঠের সুন্দর পরিবেশ যারা বিঘ্ন ঘটাবে কলেজ কৃর্তপক্ষের সহায়তায় ছাত্র সংসদ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।