বরকলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি কাঠ ব্যবসা।এই ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত জেলা ও উপজেলার প্রায় কয়েক হাজার মানুষ।কিন্তু বিগত প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে উক্ত কাঠের অন্যতম যোগানদাতা বরকলের ভুষণছড়া ও হরীনা ইউনিয়নে বন্ধ রয়েছে কাঠ ব্যবসা।এতে দিনমজুর,ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং সরকারের ট্যাক্সের মত বড়মানের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
বরকল উপজেলার কিছু ক্ষুদ্র কাঠ ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাঙামাটিতে বৈধ জোট পারমিটের মাধ্যমে কর্তন করে মজুদকৃত ৩,০১,৯৮৩ ঘনফুট সেগুনসহ বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান কাঠ যার বাজার মূল্য প্রায় শতকোটি টাকার অধিক। দীর্ঘ তিন বছর ধরে খোলা আকাশের নীচে রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হতে যাচ্ছে কাঠগুলো।বরকল উপজেলার ভুষনছড়া ও ছোট হরিণার বিভিন্ন জায়গায় গাছের স্টক দেখা গেছে।
বরকল উপজেলায় জোট মালিক ও বাগান মালিকসহ সংশ্লিষ্ট কাঠ ব্যবসায়ী, এর সঙ্গে জড়িত সাধারণ মানুষ এবং খেটে খাওয়া দিন মজুর।এরা রয়েছে চরম আর্থিক দৈন্য দশায় অভাব অনটনের মধ্যে, এদের প্রধান জিবিকা কাঠ ব্যবসা হওয়াতে,এদের ক ছেলে-মেয়ের লেখা পড়া নিয়ে এক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে বছরের পর বছর দিনাতিপাত করছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানাগেছে,এদের করুণ অবস্থার জন্য রাঙামাটির কাঠ ব্যবসায়ীরা দোষ দিচ্ছেন স্থানীয় বন বিভাগকে। তাদের মতে বন বিভাগের অসহযোগীতার কারনে আজকে এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে ।তিন বছর অপেক্ষা করে কোন উপায়ন্তর না দেখে বন্ধ হওয়া কাঠ ব্যবসা চালুকরণের জন্য তারা শিগগিরই আইনের আশ্রয় নেবেন বলে হুশিয়ারী দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাঙামাটি চাকমা সার্কেলের অধীনে মোট ১৫৯ টি মৌজার মধ্যে বরকল উপজেলায় রয়েছে মোট ২৮টি মৌজা। এর মধ্যে ১১টি মৌজায় জোট পারমিটের কাজ অর্থাৎ কাঠ ব্যবসা কোন অদৃশ্য কারনে বিগত তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে।তার কারন বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ীদেরকে ব্যাখ্যা করছে না। অথচ বাকী সব মৌজাগুলিতে জোত পারমিটের কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা বলেছেন।
রাঙামাটি বন সার্কেলের অধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ সেই ২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন সময় সম্পূর্ণ বৈধ প্রক্রিয়ায় মোট ৭১টি ফ্রি জোট পারমিট ইস্যু করেছিল। সেই পারমিটের অনুবলে এবং বন বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তরে সকল নিয়ম অনুসরন করে এসব মজুদকৃত কাঠ বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন জোট ভূমি থেকে কেটে সড়ক ও নদী পথে এনে ছোট হরিণা ১২ বিজিবি জোনের পাশ্ববর্তী দোকানঘাট এবং বড়ইতলা এলাকায় মজুদ করা হয়েছিল।
এসব মজুদকৃত কাঠের মধ্যে রয়েছে-সেগুন, গামার ও কড়ই। এসব কাঠ দীর্ঘ বছর ধরে খোলা আকাশের নীচে থাকায় বর্তমানে অর্ধেক অংশের বেশী রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে,সম্প্রতি সরেজমিনে তদন্তে গিয়ে এ বাস্তব চিত্র দেখা গেছে। ফলে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে তেমন জোত মালিকরা তাদের কাঠ বাজারজাত করতে পারছে না ।
এখানে প্রশ্ন থাকে যে, কোন অদৃশ্য কারনে বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ এসব বৈধভাবে সংগৃহীত কাঠগুলি পরিবহণ ও বাজারজাত করনে সংশ্লিষ্ট কাঠ ব্যবসায়ীদেরকে অনুমতি দিচ্ছেনা।
যার কারনে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী পাহাড়ী-বাঙালী যারা জড়িত রয়েছেন তারা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করার পর মজুদকৃত কাঠগুলি সঠিক সময়ে পরিবহণ ও বাজারজাত করতে না পেরে বর্তমানে পথের ভিখারি হওয়ার পথে বসেছেন বলে জানিয়েছেন এসব কাঠ ব্যবসায়ীরা।
বরকল কাঠ ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো: শাহ আলম বলেছেন, বন বিভাগ তাদেরকে সহযোগীতা করতেছেনা। তারা যখনই মজুদকৃত কাঠগুলি পরিবহণের জন্য ডি-ফরম অনুমোদনের জন্য বন বিভাগের কাছে গিয়েছেন তখনই তারা ডি-ফরম ইস্যু করছেনা। এ অবস্থায় বিগত তিন বছরে তাদের কাঠগুলি প্রায় পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে। তারা শিগগিরই বন বিভাগের বিরুদ্ধে মামলা করবেন এবং ক্ষতিপূরণসহ তাদের টাকা ফেরত চাইবেন বলে জানান।
একই সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল জানান, সম্পূর্ন বৈধ কাগজপত্রের মাধ্যমে এসব কাঠ স্টক করা হয়েছিল। কিন্তু বন বিভাগ কেন বা কোন কারনে পরিবহনে সহযোগীতা করছেনা তা তাদের অজানা। যার ফলে কাঠ ব্যবসা বন্ধ থাকায় এবং মজুদকৃত কাঠ গুলি পরিবহণ ও বাজারজাত করতে না পারায় আজ দিন মজুর থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট এলাকার সকল মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে দিন যাপন করছে।
অবিলম্বে বরকল উপজেলায় কাঠ ব্যবসা চালু করার জন্য সরকারের নিকট জোর দাবী জানান আব্দুল জলিল।
সেই সাথে কাঠ ব্যবসায়ের সাথে জড়িত মো: নূরুল আলম, সোহরাব হোসেন, জহির উদ্দিন তালুকদার ও মো: বখতেয়ার উদ্দীন চৌধুরীর বক্তব্য থেকে জানা যায়, যে তাঁরা বরকলে কাঠ ব্যবসা খুলে দেওয়ার জন্য প্রধান মন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও বন মন্ত্রী কাছে আবেদন করেছেন ।
স্থানীয় কার্বরী প্রতি বিন্দু চাকমা ও পুলিন চাকমা,বায়েজিদসহ আরো অনেকে হরীনা বাজারে মানববন্ধন করে একইভাবে বরকলে কাঠ ব্যবসা খুলে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবী জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো: রফিকুজ্জামান শাহ এর কাছ থেকে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, কাঠ ব্যবসায়ীদেরকে আমরা সর্বাত্মক সহযোগীতা করে যাচ্ছি। কিন্তু তারা কি কারনে সেই মজুদকৃত কাঠগুলি নিয়ে আসতে পারছেনা সেটা একমাত্র তারাই জানে। আমরা বাঁধা দিচ্ছি এ অভিযোগ সঠিক নয়। এখন নিজের দোষ পরের ঘারে চাঁপানো হচ্ছে বলে জানান এই বন কর্মকর্তা।
কাঠ ব্যবসা বন্ধের পেছনে কিছু সুত্র থেকে জানা যায়,বিগত সময় এই ব্যবসাকে টার্গেট করেই পাহাড়ের আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনের চাদার দৌরাত্ম্য বেড়েছিলো আশংকাজনক হারে।তবে বর্তমানে পরিস্থিতি পাল্টেছে।বিজিবিসহ প্রশাসনের অগ্রভুমিকায় সংগঠনগুলো এখন অনেকাংশে দুর্বল।শুধুমাত্র বড় হরীনা ইউনিয়নের কিছু এলাকা ছাড়া আর কোথাও তাদের তেমন কোন কার্যক্রম সম্পর্কে শোনা যায় না।তবে শুধু মাত্র এই একটি কারনে অপার সম্ভাবনাময় এই পেশাটি যাতে বন্ধ না হয় সে বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে।