নিউটন চাকমা, কাউখালীঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামের ১০ ভাষাভাষি ১১টি জাতিসত্ত্বাদের অবহেলিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষণ বঞ্চনা, বাস্তুভিটে হারা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের লড়াকু ও সংগ্রামী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ (এম. এন) লারমা। তিনি শুধু পাহাড়ের মানুষের নেতা ছিলেন না; তাঁর সংগ্রাম ছিল দেশের সকল শ্রেণীর নিপীড়িত গণমানুষের পক্ষে, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, অবহেলিত, ধর্ষিত, বাস্তুভিটে হারা জনড়গণের পক্ষে। মানুষে মানুষে বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। সেই বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এম এন লারমার আদর্শকে এখনো আবেগ আপ্লুত অনুপ্রেরণা হিসেবে সাহসিকতার কাজ করে। আজ ১০ নভেম্বর এই দিনে ১৯৮৩ সালে পাহাড়ি জুম্ম জাতীয় কুলাঙ্গার, উচ্চাভিলাষী ও ক্ষমতালোভী চক্রান্তকারীরা জাতীয় স্বার্থের সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গুপ্তচর ও দালালদের উস্কানীতে উচ্চ পর্যায়ের গৃহীত সিদ্ধান্তের কালি শুকোতে না শুকোতেই জাতির সাথে চরম বিশ্বাস ঘাতকতা করে এক অতর্কিত স্বশস্ত্র হামলায় গিরি, প্রকাশ, দেবেন, পলাশ চক্র পাহাড়িদের প্রিয় নেতা এম এন লারমাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
আজ সেই পাহাড়ী জনগোষ্ঠীদের মহান নেতার শহীদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা)-র ৩৮তম মৃত্যু বার্ষিকী। এ উপলক্ষে তার বিদেহী আত্নার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) ও দলের অঙ্গ সংগঠন সমূহ তার মৃর্ত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে স্নরণ সভা ও বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যে দিয়ে দিনটিকে পালন করছেন।
রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার মহাপুরম গ্রামের জুম্ম জাতির জাগরণের অগ্রদূত, মহান দেশপ্রমিক নিপীড়িত মানুষের ঘনিষ্ট বন্ধু কঠোর সংগ্রামী, ক্ষমাশীল, চিন্তাবিদ, জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৩৯ সালে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শ্রী চিত্ত কিশোর চাকমা সেই গ্রামেরই জুনিয়র হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি একজন শিক্ষাবিদ, ধার্মিক ও সমাজসেবী। স্নেহময়ী মাতা পরলোকগত সুভাষিণী দেওয়ানও একজন ধর্মপ্রাণ সমাজ সেবিকা ছিলেন।
এম এন লারমার দুই ভাই ও এক বোন। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের ফলে জন্মস্থানের বাস্তুভিটা জলে মগ্ন হলে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলাতে বসতি স্থাপন করেন। এম এন লারমা পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান। তাঁর একমাত্র বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা (মিনু) সবার বড়। তিনিও বেশ শিক্ষিত। বড় ভাই শুভেন্দু প্রবাস লারমা (বুলু) তিনিও মর্মান্তিক ঘটনায় শহীদ হন। শহীদ শুভেন্দু লারমা রাজনৈতিক জীবনে একজন সক্রিয় সংগঠক, বিপ্লবী ও একনিষ্ঠ সমাজ সেবক ছিলেন। ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) তিনি পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। তিনি একজন বিপ্লবী নেতা, সংগঠক, সমাজ সেবক, নিপীড়িত, জাতি ও জুম্ম জনগণের একনিষ্ঠ বিপ্লবী বন্ধু মহান দেশপ্রেমিক ও কঠোর সংগ্রামী নেতা। বর্তমানে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি (পিসিজেএসএস) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি ১৯৫৮ সালে রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় হতে মেট্রিক (এসএসসি) পাশ করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম সরকারী মহাবিদ্যালয়ে আইএ ভর্তি হন এবং ১৯৬০ আইএ পাশ করেন। আইএ পাশ করে একই কলেজে বিএ-তে ভর্তি হন। অধ্যয়নরত অবস্থায় রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত দেখিয়ে পাকিস্তান সরকার তাকে নিরাপত্তা আইনের অধীনে ১০ই ফেব্রুয়ারী ১৯৬৩ সালে গ্রেপ্তার করে এবং প্রায় সুদীর্ঘ দুই বৎসরের অধিক কারাবরণ করার পর শর্তসাপেক্ষে ৮ই মার্চ ১৯৬৫ সালে মুক্তি পান।
তিনি সমাজ কল্যাণ বিভাগের অধীনে একই বছরে বিএ পাশ করেন। ১৯৬৮ সালে বিএড পাশ করেন এবং ১৯৬৯ সালে এলএলবি পাশ করে একজন আইনজীবি হিসেবে চট্টগ্রাম বার এ্যাসোসিয়েশনে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরাঞ্চল হতে সকল প্রতিদ্বন্দীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
তারপরে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসনে প্রতিদ্বন্দিতা করে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সংসদ সদস্য হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত লাভ করেন। বাংলাদেশ গণপরিষদে সদস্য থাকার সময়ে সরকারি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অধিকার আদায়ের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে তখন নিয়মতান্ত্রিক ভাবে সংগ্রামের পাশাপাশি অনিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের কথাও এম এন লারমা ভাবতে লাগলেন।
অবশেষে, ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী এম এন লারমার নেতৃত্ত্বে গঠিত হলো, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ‘‘শান্তিবাহিনী’’ নামে। পাশাপাশি এম এন লারমার সভাপতিত্বে বলিষ্ট নেতৃত্বে গড়ে উঠলো গ্রাম পঞ্চায়েত, মহিলা সমিতি, যুব সমিতি ও মিলিশিয়া বাহিনী।
আরোপড়ুন :- বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের নানিয়ারচর শহীদ মিনারে পুষ্প মাল্য দান।
অপরদিকে সামরিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ এম এন লারমার শক্ত পরিচালনায় ও শিক্ষায় শান্তিবাহিনী ক্রমান্বয়ে এক শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল মুক্তি বাহিনীতে গড়ে উঠে। শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সাহস, কষ্ট সহিঞ্চুতা, ধৈর্য্য, মনোবল ও সামরিক দক্ষতা দেখে অনেকের মনে ত্রাসের সঞ্চার হলো।
দেশ-বিদেশে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার সংগ্রামের কথা, শান্তিবাহিনীর বীরত্বের কথাও প্রচার হতে থাকে তৎকালীন সময়ে। তখন থেকে আস্তে আস্তে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে এম এন লারমা অতি দক্ষতার সহিত সুকৌশলে এসবের মোকাবেলা করে আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন।
এভাবে চলতে চলতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের গড়ে উঠা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ক্ষমতার লোভে জাতীয় কুলাঙ্গার, উচ্চাভিলাষী ও ক্ষমতালোভী চক্রান্তকারীরা জাতীয় স্বার্থের সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গুপ্তচর ও দালালদের উস্কানীতে জাতির সাথে চরম বিশ্বাস ঘাতকতা করে স্বশস্ত্র হামলা করে গিরি, প্রকাশ, দেবেন, পলাশ চক্র পাহাড়িদের প্রিয় নেতা মানবেন্দ্র লারমা(এম এন লারমা)-কে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে।
তারপরও পার্বত্য চট্টগ্রামের দাবী আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন থেমে থাকেনি। এই প্রেক্ষিতে বিগত ২রা ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এক অনারম্বড় পরিবেশে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে। এ সুবাদে আজ পার্বত্য অঞ্চলে কিছুটা হলেও শান্তির সুবাতাস বইছে।
পাহাড়িদের শহীদ মহান নেতা এমএন লারমার ৩৮তম মৃর্ত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিভ ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ), পাহাড়ি ছাত্র পরিষদসহ আঞ্চলিক রাজনৈতিক অঙ্গ সংগঠন রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ স্নরণ সভা, লারমার আত্নজীবনীর উপর আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচী এবং র্যালীর আয়োজন করা হয়েছে।