বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) ব্যবস্হাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদ সাব্বির বলেছেন, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিএসসি’র আয় ছিল ২৭৯ দশমিক ৯০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আয় হয়েছে প্রায় ৪২ দশমিক ৯৪ কোটি টাকা। সর্বমোট আয় হয় প্রায় ৩২২ দশমিক ৮৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে পরিচালনা ব্যয় ছিল ১৭৭ দশমিক ৭৩ কোটি টাকা এবং প্রশাসনিক ও আর্থিক খাতে ব্যয় ছিল ৬৭ দশমিক ৬৩ কোটি অর্থাৎ সর্বমোট ব্যয় ২৪৫ দশমিক ৩৬ কোটি টাকা। আর্থিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত অর্থবছরে কর সমন্বয়ের পর এ প্রতিষ্ঠানের নিট মুনাফা হয়েছে মাত্র ৪১ দশমিক ৪৭ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছর অর্থাৎ গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিএসসি’র আয় হয়েছিল ২২২ দশমিক ৯৮ কোটি টাকা এবং ব্যয় ১৮৫ দশমিক ১০ কোটি টাকা। কর সমন্বয়ের পর নীট মুনাফা হয়েছিল ১৭ দশমিক ৫১ কোটি টাকা। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিএসসির নীট আয় বেড়েছে ২৩ দশমিক ৯৬ কোটি টাকা। পরিচালনা পর্ষদ শেয়ারহল্ডোরগণকে গত অর্থবছরের জন্য ১০ শতাংশ প্রদানের সুপারিশ করেছে। বিএসসি’র সম্মেলন কক্ষে বার্ষিক সাধারণ সভা উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। আগামী ২৩ ডিসেম্বর বেলা ১১ টায় বিএসসি’র ৪৩তম বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
তিনি বলেন-রাষ্ট্রীয় সংস্হা হিসেবে দেশের সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানে আমদানিকৃত পণ্য বিএসসির মাধ্যমে পরিবহন করা উচিত। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়সহ ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব। সেই লক্ষ্যে গত বছরের ১২ নভেম্বর সংসদে বাংলাদেশ ফ্লাগ ভেসেল (প্রটেকশন) বিল-২০১৯ পাশ হয়। যার মাধ্যমে সরকারি আমদানি-রপ্তানিকৃত পণ্য সমুদ্রপথে পরিবহনের অগ্রাধিকার বিএসসিকে দেয়া হয়েছে। কিন’ এ আইন অমান্য করে সরকারি সংস্হার আমদানিকৃত পণ্য নিজস্ব উদ্যোগে পরিবহনের প্রবণতা থাকায় বিএসসির জাহাজসমূহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ পণ্যগুলো পরিবহনে সহায়তা করতে পারছে না। এতে একদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় সংস্হা বিএসসির উন্নতিও ব্যাহত হয়েছে । এই আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিএসসি ভবিষ্যতে লাভজনক ও ঝুঁকিমুক্তভাবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করে অধিক লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে বলে আশা করা যায়।
কমডোর মাহমুদ সাব্বির বলেন, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বিএসসি সর্বমোট ৪৪টি জাহাজ অর্জন করেছে। ৮০ এর দশকের প্রথমদিকে বিএসসি’র বহরে একসাথে সর্বমোট ২৮টি জাহাজ ছিল। বয়সজনিত কারণে এবং বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক বিবেচিত হওয়ায় বিভিন্ন পর্যায়ে ৩৬টি জাহাজ বিক্রি করার পর বর্তমানে বিএসসি’র জাহাজের সংখ্যা মাত্র ৮টি। এর মধ্যে ৬টি নতুন জাহাজ গত বছর যুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে দেশের বর্তমানে আমদানি রপ্তানি পণ্য পরিবহনে সমুদ্রগামী জাহাজ ভাড়া বাবদ প্রচুর অর্থ বিদেশি জাহাজ মালিকরা নিয়ে যা”েছ। ফলে আমরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি । অদূর ভবিষ্যৎ পরিবহন ব্যয় ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাবে। তাই বিএসসি’র মত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় এ প্রতিষ্ঠানে দেশের বর্তমান চাহিদা বিবেচনায় ন্যূনতম ৪০-৫০টি জাহাজ থাকা দরকার। কিন’ বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারণে বিশেষ করে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্হান করতে না পারায় সে পরিমাণ জাহাজ বিএসসি’র বহরে সংযোজন করা সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমান সরকারের পৃষ্টপোষকতায় বিএসসি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । ইতোমধ্যে ব্লু ইকোনমি বাস্তবায়নে রূপকল্প-২০২১ এবং রূপকল্প -২০৪১ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিশ্বমানের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক শিপিং সংস্হা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাণিজ্যিক জাহাজ বহর সৃষ্টিসহ আনুষাঙ্গিক নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে
বিএসসি’র ব্যবস্হাপনা পরিচালক বলেন, সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে চীনের অর্থায়নে ৬টি (৩টি বাল্ক ক্যারিয়ার ও ৩টি অয়েল ট্যাংকার) নতুন জাহাজ বিএসসির বহরে যুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে রামপাল, পায়রা ও মাতারবাড়িতে তিনটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা বিদেশ হতে আমদানি করা হবে। সমুদ্রপথে নিরবিচ্ছিন্ন পণ্য পরিবহন ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য ২টি মাদার বাল্ক ক্যারিয়ার ও মাদার ভেসেল থেকে লাইটারিংয়ের জন্য আরো ১০টি বাল্ক ক্যারিয়ার ক্রয় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া ইস্টার্ন রিফাইনারির ক্রুড অয়েল পরিশোধন ক্ষমতা ভবিষ্যতে দ্বিগুণ হবে। সমস্ত ক্রুড অয়েল বিএসসি’র নিজস্ব জাহাজের মাধ্যমে পরিবহনের জন্য আরো ২টি মাদার ট্যাংকার ক্রয় সংক্রান্ত প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) প্রতি বছর ৩০ লাখ টন ডিজেল অয়েল এবং সাড়ে ৩ লাখ টন জেট ফুয়েল আমদানি করে, যা বিদেশি জাহাজের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়। ইস্টার্ন রিফাইনারি কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) এবং ডাবল পাইপলাইন শীর্ষক প্রকল্প দুটি সমাপ্ত হলে আমদানিকৃত ডিজেল ও জেট ফুয়েল পরিবহনে ২টি মাদার প্রোডাক্ট অয়েল ট্যাংকার সংগ্রহের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
কমডোর মাহমুদ সাব্বির বলেন, দেশের জ্বালানি সংকট নিরসনে সরকার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই লক্ষ্যে কঙবাজার মাতারবাড়িতে এফএসআরইউ টার্মিনাল স্পাপন করা হচ্ছে । যা দেশের জাতীয় গ্যাস গ্রিডের সাথে যুক্ত থাকবে। দেশের গ্যাস চাহিদা পূরণে এলএনজি আমদানির জন্য বিএসসি বহরে মোট ৬টি এলএনজি ভেসেল যুক্ত করার প্রাথমিক পরিকল্পনা ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। শ্রীলংকাসহ বিমসটেকের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে শিগগিরই ফিডার সার্ভিস চালু হবে। এ বিষয়টি বাস্তবায়নে ৪টি সেলুলার কন্টেনার জাহাজ ক্রয় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএসসির পরিচালক কাজী শফিউল আলম, ড. পিযূষ দত্ত, প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইউসুফ, সচিব খালেদ মাহমুদ, মহাব্যবস্থাপক আশরাফুল আমিন প্রমুখ।