চট্টগ্রামের মানুষকে আমি ভালোবাসি” নিজের ৭২তম জন্মবার্ষিকীতে চট্টগ্রামবাসীকে শুভেচ্ছা জানাতে উক্তিটি করেছিলেন তিনি। কারো কাছে ছিলেন রাজনৈতিক গুরু, কারো কাছে সহযোদ্ধা, কেউবা তাঁকে মানতেন অভিভাবক, কারো কাছে এখনো ‘মেয়র সাব’। সবকিছুর ঊর্ধ্বে তিনি ছিলেন একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ। চারিত্রিক দৃঢ়তা, আপোষহীন মানসিকতা, অসাধারণ সম্মোহনী শক্তি, কোমলতা-কঠোরতার সংমিশ্রণ তাঁকে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষে পরিণত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ ছিল তাঁর সারাজীবনের সংগ্রাম। মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক ও চট্টলবীরকে আজ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি।
২০০৬ সালের ২৭ জুন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হন তিনি। তার আগে দুই-দুইবার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ষাটের দশকে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ছাত্র থাকাকালে সক্রিয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে এম.এ. অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। সেসময় সংগঠনের সভাপতি মৌলভী সৈয়দ ও মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয় চট্টগ্রাম। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ “সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ” এর নেতৃত্বে লালদীঘি ময়দানে জনসভার ডাক দেন তিনি। সেই জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় তাঁর নেতৃত্বে। ৭মার্চ মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের ছাত্রকর্মীরা যোগ দিয়েছিলেন ঐতিহাসিক রেসকোর্সের জনসভায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মার্চেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের উত্তর প্রদেশের তান্দুয়া কেন্দ্রের প্রশিক্ষণ শেষে মাউন্ট ব্যাটালিয়নে প্লাটুন কমান্ডার নিযুক্ত হন মহিউদ্দিন চৌধুরী। পরে বিএসএফ এর মিডল ও সাউথ কলামের কমান্ডার হন তিনি। পাহাড়ি এলাকায় ৩০০ মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতা হিসেবে সম্মুখ সমরে নেতৃত্ব দেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। বিজয়ের পর ১৮ ডিসেম্বর বিজয়ীর বেশে চট্টগ্রামে ফেরেন মহিউদ্দিন ও তাঁর সহযোদ্ধারা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ নিতে সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য মৌলভী সৈয়দ ও তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে “মুজিব বাহিনী”। পরে “চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা”র আসামি করা হয় তাঁকে। বাধ্য হন কলকাতায় যেতে। ১৯৭৮ সালে তিনি দেশে ফেরেন। পরে শ্রমিক রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। অদম্য সাহসী ও সংগঠক মহিউদ্দিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় গেলেন দলবল নিয়ে, ঝাঁপিয়ে পড়লেন বঙ্গবন্ধু কন্যার জন্য। সব বাধা অতিক্রম করে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দলের কান্ডারির দায়িত্ব নিতে ভূমিকা রাখলেন।
১৯৭৬ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন করে গ্রেফতার হয়েছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য কয়েকজন সংগঠককে নিয়ে চট্টগ্রামে অভাবনীয় বিজয় মেলার আয়োজন করেছিলেন। ৯০ পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্বাধীনতা-মুক্তি তথা বিজয়ের গান, স্মৃতিচারণ ও জনতার মঞ্চ প্রভৃতি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চট্টলবাসীর হৃদয়ে প্রোথিত করেছিলেন। বিজয়মেলা এখন পরিণত হয়েছে বাঙালির স্বাধীনতার উৎসবে।
চট্টগ্রামের মানুষ অতিথি-বৎসল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু মহিউদ্দিন চৌধুরীর অতিথি বৎসল্যতা আরও ভিন্ন যা সকলের মনে আলাদা স্থান দিয়েছে। অতিথি যেন তাঁর কাছে মহাআশীর্বাদের। অতিথিকে খাইয়ে-দাইয়ে তুষ্ঠ করাই ছিল যেন তাঁর আরাধনা। চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা, রাজনীতিক নেতাকর্মী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের খুবই কমই আছেন যারা তাঁর বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করেনি। কেউ যদি তাঁর বাসা থেকে খালি মুখে যেতে চাইত তাহলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলতেন-‘ন খায় গেলে গৃহস্থের অমঙ্গল হয়।’ উনার বাসায় সর্বদা অঘোষিত মেজবান দেখা যেত। প্রতি বছর রমজান মাসের ত্রিশদিন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় জি.ই.সি ক্যাম্পাসে হাজার হাজার রোজাদারদের ইফতার করিয়ে অনন্য নজির গড়েন তিনি।
২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পূর্বেও তিনি চট্টগ্রামের উন্নয়নের স্বার্থে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট খোলা চিঠি দিয়েছিলেন এবং চট্টগ্রামকে নিয়ে ভেবেছেন শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থতার কারণে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা কিংবা সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হলেও তাঁর ভাবনা, আরাধ্য ও স্বপ্নের শহর চট্টগ্রামের মাটিতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চট্টগ্রামেই তাঁকে দাফন করা হয়। চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষকে তিনি আমৃত্যু ভালোবেসেছেন। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর এ মহান পুরুষের জীবনাবসান হয়। মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুতে সমগ্র চট্টলবাসী যেন অভিভাবকহীন হয়ে গেলেন। একটি পরিণত বয়স, দীর্ঘদিনের ঘাত-প্রতিঘাত-সংগ্রামে গড়ে ওঠা জীবনের প্রদীপ যেন সামান্য ঘায়ে নিভে গেল, যেটি চট্টগ্রামের মানুষ কোনদিন ভুলতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মৃত্যুঞ্জয় কবিতায় লিখেছেন,
“তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড়ো নও,/ আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়ো-”
তাঁর চিন্তা ও কর্মে বিকশিত হয়েছেন নবজাগরণের গন্ধে, নব বিকাশের বলে এবং মৃত্যুর চেয়ে বড় হয়ে রইলেন আমাদের মহিউদ্দিন চৌধুরী।
প্রগতির পক্ষে নিখাদ ছিল তাঁর হৃদয়বৃত্তি। প্রতিক্রিয়াশীলতা ও অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর মানসিক বুনিয়াদ ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। সত্যিকার একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন তিনি। এ বিষয়ে ন্যূনতম কোনো আপোষ দেখিনি তাঁর মধ্যে। যে আপোষহীন ব্যক্তিত্ব তাঁর সুযোগ্য সন্তান সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের ব্যাক্তিত্বের মধ্যেও দৃষ্ট হয়। তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ‘ব্রেইন চাইল্ড’ হিসেবে এখন প্রতীয়মান। বাংলাদেশ তথা চট্টগ্রাম নিয়ে অনেক প্রত্যাশা তাঁর। তিনি চট্টলবীরের যোগ্য উত্তরসুরী।