ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচনে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের মধ্যে বৈঠকে এ বিষয়ে ঐকমত্য হয়। বৈঠক শেষে যুব উন্নয়ন, কৃষি, কারিগরি শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে ছয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে। সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানানো রাজাপাকসে বিকালে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সন্ধ্যায় দুই দিনের সফর শেষে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। শুক্রবার সকালে ঢাকায় আসা শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে স্বাগত জানান। দুই নেতা প্রথমে একান্ত বৈঠকে মিলিত হন। পরে দুই দেশের প্রতিনিধি দল দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসে। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বলেন, প্রায় এক ঘণ্টার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ সম্ভাবনার চেয়ে অনেক কম। সে জন্য মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করার বিষয়ে জোর দিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে যৌথ ফিজিবিলিটি স্টাডি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের এখন দ্রুত মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে (এফটিএ) যাওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রীলঙ্কার বাজারে বাংলাদেশের অনেক পণ্যের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা বৈঠকে উল্লেখ করেন। সেই সঙ্গে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে দুই দেশের বিদ্যমান সম্পর্কের কথা তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আগামী বছর দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শ্রীলঙ্কা সফরের আমন্ত্রণ জানান রাজাপাকসে। তিনি বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরের প্রশংসা করেন এবং দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং ব্যবসার ক্ষেত্র বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। তিনি ব্লু ইকোনমি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের আগ্রহ প্রকাশ করেন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধি দলে ছিলেন দেশটির শিক্ষামন্ত্রী জি এল পিরিস, রুরাল হাউজিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল ইন্ডাস্ট্রিজ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ইন্দিকা আনুরুদ্ধ, বাটিক, হ্যান্ডলুম ফেব্রিক অ্যান্ড লোকাল অ্যাপারেল প্রোডাক্টস বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দায়াসিরি জায়াসেকারা, মানি অ্যান্ড ক্যাপিটাল মার্কেট অ্যান্ড স্টেট এন্টারপ্রাইজ রিফর্মস বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আজিথ নিওয়ারড কাবরাল, আঞ্চলিক সহযোগিতা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তারক বালাসুরিয়া, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর সচিব গামিনি সেদারা সেনারাথ। পরে দুই নেতার উপস্থিতিতে যুব উন্নয়ন, কৃষি, কারিগরি শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে ছয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে যুব উন্নয়নে সহযোগিতা জোরদারে একটি সমঝোতা স্মারকে বাংলাদেশের পক্ষে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও শ্রীলঙ্কার পক্ষে রুরাল হাউজিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল ইন্ডাস্ট্রিজ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ইন্দিকা আনুরুদ্ধ সই করেন। বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএআরসি) এবং শ্রীলঙ্কার কাউন্সিল ফর এগ্রিকালচারাল রিসার্চ পলিসির (এসএলসিএআরপি) মধ্যে সমঝোতা স্মারকে বাংলাদেশের পক্ষে কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক এবং শ্রীলঙ্কার পক্ষে বাটিক, হ্যান্ডলুম ফেব্রিক অ্যান্ড লোকাল অ্যাপারেল প্রোডাক্টস বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দায়াসিরি জায়াসেকারা সই করেন। বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর (ডিটিএ) এবং শ্রীলঙ্কার টারশিয়ারি অ্যান্ড ভোকেশনাল এডুকেশন কমিশনের (টিভিইসি) মধ্যে কারিগরি সহযোগিতা বিনিময়ে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেন বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এবং শ্রীলঙ্কার শিক্ষামন্ত্রী জি এল পিরিস। নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণে সহযোগিতা বাড়াতে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও শ্রীলঙ্কার পক্ষে মানি অ্যান্ড ক্যাপিটাল মার্কেট অ্যান্ড স্টেট এন্টারপ্রাইজ রিফর্মস বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আজিথ নিওয়ারড কাবরাল একটি সমঝোতা স্মারক সই করেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এবং শ্রীলঙ্কার লক্ষণ কাদিরগামার ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। তাতে সই করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এবং শ্রীলঙ্কার পক্ষে তাদের আঞ্চলিক সহযোগিতা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তারক বালসুরিয়া। ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সফর বিনিময়ে আরেকটি সমঝোতায় সই করেন সংস্কৃতি বিষয়ক সচিব এম বদরুল আরেফিন এবং শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর সচিব গামিনি সেদারা সেনারাথ। মাহিন্দা রাজাপাকসের সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে দুই নেতা গুরুত্বারোপ করেন। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনে বাংলাদেশ আগ্রহী। এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে একটি অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) স্বাক্ষর প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে দুই পক্ষ সম্মত হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে শিপিং কানেকটিভিটির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে বৈঠকে চট্টগ্রাম-কলম্বো ফিডার সার্ভিস পরিচালনা এবং উপকূলীয় জাহাজ চলাচল সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে দুই দেশ একমত হয়েছে। এ ছাড়া দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ সম্প্রসারণ, দ্বৈত কর পরিহার ও কাস্টমস সহযোগিতার বিষয়ে দ্রুত চুক্তি সম্পাদনেরও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধপণ্য অধিক পরিমাণে আমদানির জন্য শ্রীলঙ্কার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্ভাবনাময় খাতে শ্রীলঙ্কা থেকে বর্ধিত বিনিয়োগেরও আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশ মৎস্য, কৃষি, বিশেষত ধান উৎপাদন, জলবায়ু অভিযোজন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও আইটি সেক্টরে শ্রীলঙ্কাকে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ সহযোগিতা দেবে। অন্যদিকে, সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ ও নার্সিং সেক্টরে শ্রীলঙ্কা থেকে সহযোগিতা পেতে বাংলাদেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বৈঠকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে চলমান সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে দুই প্রধানমন্ত্রী অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুর বিস্তারিত প্রেক্ষাপট, পরিস্থিতি ও প্রত্যাবাসন বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করে এই ইস্যুতে বাংলাদেশকে সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদানের জন্য শ্রীলঙ্কাকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।