মিজানুর রহমান সবুজ, দীঘিনালা সংবাদদাতা :
১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস বাংলাদেশি শরনার্থী ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার প্রমাণপত্র থাকলেও এখনও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি খাগড়াছড়ির দীঘিনালার পশ্চিম কাঁঠালতলী গ্রামে মৃত বিশ্ব নাথ বড়ুয়ার পুত্র প্রয়াত স্বদেশ রঞ্জন বড়ুয়ার। ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারি তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বরাবর আবেদন করেন। দূর্ভাগ্যবশত আবেদন করার এক বছর ৫ মাস পর ২০১৮ সালের ২৬ মে স্বদেশ রঞ্জন বড়ুয়া অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, প্রয়াত স্বদেশ রঞ্জন বড়ুয়ার মুক্তিযুদ্ধকালীন ঠিকানা ছিল চট্টগ্রামের রাউজানের পাহাড়তলী মহামুনি। ১৯৭১ সালে তিনি ২২ বছরের এক টগবগে যুবক।তখন তিনি ম্যালেরিয়া অধিদপ্তরের রাঙামাটি বরকল থানায় সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তান সরকারের চাকরী ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য টেগামূখ পাহাড় পার হয়ে ১৯ এপ্রিল ১৯৭১ দেমাগ্রী যুব ক্যাম্পে পৌঁছান। এবং তৎকালীণ আসাম রাজ্যের মিজো জেলার দেমাগ্রীর দায়ীত্বপ্রাপ্ত সহকারী ডেপুটি কমিশনার সি নাগের কাছে রিপোর্ট করেন। তাঁর সঙ্গীয় ছিল বরকল থানার তৎকালীণ সার্কেল অফিসার, পুলিশের কর্মকর্তা, ফরেষ্ট রেঞ্জার, পুলিশ সদস্য জবরদস্ত খাঁন, সুনীল বড়ুয়াসহ আরও অনেকে। তাঁর ভারতের রেজি নং-১৫০৮৫০। সে সময় তিনি স্বশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাইলে তাঁকে একজন স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশী শরণার্থী ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ক্যাম্পের দায়ীত্ব পালনের জন্য বলা হয়। তিনি দেমাগ্রী ইয়থ ট্রানজিট ক্যাম্প ও সহকারী ডেপুটি কমিশনারের নির্দেশনাক্রমে দেমাগ্রী ডিসপেনসারীর দায়ীত্বপ্রাপ্ত সহকারী সার্জন ডা. কে. এন শর্মার অধীনে মুক্তিযোদ্ধাকালীন সময়ে ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দায়ীত্ব পালন করেন। দেমাগ্রীতে দায়ীত্ব পালনকালীণ সময়ে দীঘিনালা উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের হারুণ অর রশিদ ও মৃত মুক্তিযোদ্ধা মিলন বড়ুয়ার সাথে তাঁর নিয়মিত দেখা স্বাক্ষাত ও কথা হতো। দেশ স্বাধীন হলে তিনি ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনায় পুনঃরায় রাঙামাটি জেলায় ম্যালেরিয়া অধিদপ্তরে কাজে যোগদান করেন। এবং সরকারের বিশেষ নির্দেশনায় যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদেরকে ৯ মাসের বেতন পরিশোধ করা হয়। তিনিও নয় মাসের সরকারি বকেয়া বেতন পান। দীর্ঘ বছর চাকরি করার পর অসুস্থ্যতা জনিত কারণে ২০০২ সালে তিনি সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক হিসেবে দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হতে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন সনদ ও সুযোগ সুবিধা নেননি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য দীঘিনালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাইবাছাই কমিটি ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) কাছে সুপারিশসহ প্রতিবেদনও পাঠায়৷ কিন্তু কোন স্বীকৃতি মিলেনি৷
প্রয়াত স্বদেশ রঞ্জন বড়ুয়া ছিলেন তিন সন্তানের জনক। প্রথম সন্তান পলাশ বড়ুয়া দীর্ঘদিন যাবৎ প্রথম আলো পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। বাকি ২ সন্তান বেকার৷ মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ সনদ ও সুযোগ সুবিধার প্রতি আগ্রহ না থাকলেও জীবনের শেষ দিকে এসে এ বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তিনি।
তার প্রথম সন্তান সাংবাদিক পলাশ বড়ুয়া বলেন, আমার বাবা যে দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন সে মাতৃভূমির লাল সবুজের পতাকা তাঁর কফিনে স্থান পায়নি। একমাত্র কারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি না থাকা। জানি না আমার বাবার মতন স্বীকৃতি না পাওয়া দেশে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। কেউ মারা গেছেন বা কেউ জীবিত রয়েছেন। তাঁদের ভাগ্যেও হয়তো লাল সবুজের পতাকা কফিনে স্থান পাবে না। যারা প্রকৃতভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাঁদেরকে যাচাইবাছাই করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হোক। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যেন রাষ্ট্রীয় সম্মান থেকে বঞ্চিত না হয়। জয় বাংলা, বাংলার জয়।
দীঘিনালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি হারুনুর রশিদ জানান,২০২১ সালের ৩১ আগস্ট জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) কাছে স্বদেশ রঞ্জন বড়ুয়া পক্ষে আমি স্বাক্ষী হয়ে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করেছি।