মোঃ সিরাজুল মনির,চট্টগ্রাম ব্যুরো।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী কর্ণফুলী নদী বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হলেও এ নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে আমদানিকৃত পণ্যের বেশ কয়েকটি চোরাই সিন্ডিকেট। আমদানিকৃত তেল, স্ক্র্যাপ, কয়লা, গম, ভুট্টা, সয়াবিজ চোরাইয়ে জড়িত বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করেছে নৌ-পুলিশ। এসব চুরির সাথে জাহাজের মাস্টার সুপারভাইজার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাও জড়িত। পাশাপাশি পুলিশি তৎপরতায় বন্ধ হয়ে গেছে ক্যাশিয়ার প্রথাও। পুলিশ বলছে, আমদানিকৃত পণ্যের চোরাই বন্ধে কর্ণফুলী নদীতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বেড়েছে নৌপুলিশের নিরাপত্তা সরঞ্জামও। এতে যেকোন মুহুর্তে দ্রুততম সময়ে নদীতে অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সদরঘাট নৌ থানার ওসি এবিএম মিজানুর রহমান।
আমদানিকৃত পণ্য চোরাইরোধে অভিযান ও মামলা – গত ৩০ সেপ্টেম্বর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চোরাই স্ক্র্যাপ বহন করার সময় কর্ণফুলী নদীর ইছানগর ডায়মন্ড সিমেন্ট ঘাটের সামনে থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা আটক করে নৌ-পুলিশ। অভিযানের সময় কয়েকজন পালিয়ে গেলেও পুলিশ সদস্যরা নৌকা থেকে জাহাঙ্গীর আলম (২৪), আবু বক্কর ছিদ্দিক (২৬), মো. শামীম (৩০), মো. মাসুদ (২৮), মো. সাগর (২৫) ও জাকির হোসেনসহ (২৬) ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। ওই নৌকা থেকে দেড় টন আমদানিকৃত চোরাই স্ক্র্যাপ লোহা জব্ধ করে পুলিশ। এসময় গ্রেপ্তার হওয়া চোরাই চক্রের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে, স্ক্র্যাপগুলো ‘এমবি সী-মুন’ নামের স্ক্র্যাপবাহী লাইটার জাহাজ থেকে জাহাজের মাস্টার ও এস্কট পার্টির লোকজনের যোগসাজশে বিক্রির জন্য নেওয়া হচ্ছিল। চুরির সাথে কর্ণফুলী উপজেলার পেশাদার চোরাই পণ্য ব্যবসায়ী মো. ইব্রাহীম প্রকাশ কালু সওদাগর (৫০), ‘এমবি সী-মুন’ জাহাজটির মাস্টার মো. নাজিম উদ্দিন (২৮) ও জিএমএস ইন্টারন্যাশনাল নামের সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানের এস্কট মো. জামালসহ (২০) ৯ জনের বিরুদ্ধে কর্ণফুলী থানায় মামলা করে সদরঘাট নৌ-থানার এসআই আনোয়ারুল ইসলাম।
এর আগে কর্ণফুলী নদীতে দুর্ঘটনায় ডুবে যাওয়া স্ক্র্যাপবোঝাই ‘এমভি বর্নীয়-২’ জাহাজ হতে ১৪ সেপ্টেম্বর ভোরে ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে এসে চোরাইচক্রের ৫/৬জন স্ক্র্যাপ বোঝাই করে পালিয়ে যায়। পরে নৌ-পুলিশ খবর পেয়ে অভিযান চালিয়ে দেখতে পায়, বাংলাবাজার এলাকায় নদীতে থাকা নৌকা হতে চোরাই স্ক্র্যাপগুলো যাত্রী ছাউনির পাশে অবস্থান করা ঢাকামেট্রো-ট-১১-১০৫৭ ট্রাকটিতে বোঝাই করা হচ্ছে। এসময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে চোরাইচক্রের সদস্যরা পালিয়ে যায়। পুলিশ ট্রাক ও নৌকা দুটিসহ দুইটন ৮০ কেজি স্ক্র্যাপ লোহা জব্দ করে। এই ঘটনাতেও স্থানীয় লোকজনের সাক্ষ্যতে চোরাই পণ্য ব্যবসায়ী কালু সওদাগর ও ইয়ার মোহাম্মদ নামের দুই জনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করে নৌ-পুলিশ।
গত ২২ সেপ্টেম্বর ভোরে অভিযান চালিয়ে বহির্নোঙর থেকে চোরাই আমদানিকৃত গমভর্তি করে আসা একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা কর্ণফুলী নদীর শাহমীরপুর বাল্যপুকুর এলাকা হতে আটক করে পুলিশ। এসময় নৌকাসহ চোরাই দুইটন গম জব্দ করে নৌ-পুলিশ। পরে স্থানীয়দের সাক্ষ্যতে মো. রুস্তম (৩২), মো. ইলিয়াছ (৫২), নুরুল হুদা (৩৬), তুষার (৩২), নুর বঙ (৩২), মো. এসকান্দর প্রকাশ মদন (৪০), মো. ইসহাক (৫০), মো. জাহাঙ্গীর (৩৬), মো. তাহের প্রকাশ আকাশ (২১), মো. ইলিয়াছসহ (৪৬) কর্ণফুলী থানায় মামলা করে নৌ-পুলিশ।
এর আগে ১৮ জুলাই বহির্নোঙর থেকে চুরি করে আনা এক টন করে সয়াবীজসহ দুইটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা কর্ণফুলী নদীর শাহমীরপুর বাল্য পুকুর এলাকা হতে আটক করে। এসময় আজগর আলী (৪৭) নামের একজনকে আটক করতে পারলেও অন্যরা পালিয়ে যায়। পরে ধৃত আসামীিক জিজ্ঞাসাবাদে মো. নুর বঙ (৫০), ইসকান্দর (৫০), মো. জাহাঙ্গীর (৫০) ও মো. ইসহাকসহ (৫৫) ৫ আসামির বিরুদ্ধে কর্ণফুলী থানায় মামলা দায়ের করে নৌ-পুলিশ।
সর্বশেষ গত ৭ ডিসেম্বর গভীর রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কর্ণফুলী নদীতে অভিযান চালিয়ে ভোজ্য তেলের অপরিশোধিত আড়াই হাজার লিটার ক্রুড অয়েলবাহী একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা জব্দ করার পাশাপাশি মো. সেলিম (৩৪)। মো. সাদেক (৩৫), আবদুর রহিম (৩৫), মো. ইব্রাহীম (৩৭) ও মো. লোকমান (৪০) নামের ৫জনকে গ্রেপ্তার করে নৌ-পুলিশ। এনিয়ে ৮ ডিসেম্বর কর্ণফুলী থানায় একটি মামলাও হয়।
কর্ণফুলী নদীকেন্দ্রিক চোরাইচক্র চিহ্নিত ঃ কর্ণফুলী নদী হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রাণ। চট্টগ্রাম প্রধানতম সমুদ্র বন্দর হওয়াতে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সিংহভাগ আমদানি-রপ্তানি পণ্য খালাস ও জাহাজীকরণ হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে একটি বিরাট অংশ বাল্ক জাহাজ করে আমদানি হয়। পরে বহির্নোঙর থেকে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় খালাস হয়। বাল্কবাহী জাহাজে আসা পণ্যের মধ্যে স্ক্র্যাপ, কয়লা, সার, গম, সয়াবীজ, ভুট্টা আমদানি বেশি হয়। খোলা জাহাজে আমদানির সুযোগে বহির্নোঙরের মাদার ভ্যাসেল থেকে এবং লাইটারিংয়ে নিয়োজিত লাইটার জাহাজ থেকে আমদানিকৃত এসব পণ্য চোরাইয়ের সাথে জড়িত কর্ণফুলী নদীকেন্দ্রিক বেশ কয়েকটি চোরাই সিন্ডিকেট। বিগত কয়েক মাসে এসব সিন্ডিকেটগুলোকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। চিহ্নিত এসব চোরাই সিন্ডিকেটের মধ্যে জাহাজের মাস্টার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাও রয়েছেন। বেশ কয়েকটি অভিযানে চোরাইপণ্যসহ কমপক্ষে ৬টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা, একটি ট্রাকও জব্ধ করা হয়। চোরাই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মামলাও হয়।
এ ব্যাপারে সদরঘাট নৌ থানার ওসি এবিএম মিজানুর রহমান বলেন, বিগত কয়েক মাসে রাতদিন কর্ণফুলী নদীতে অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকটি চোরাই চক্রকে আমরা চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করেছি। কর্ণফুলী, কোতোয়ালী থানা বেশ কয়েকটি মামলাও হয়েছে। পতেঙ্গাকেন্দ্রীক একটি শক্তিশালী চোরাই সিন্ডিকেট রয়েছে। কর্ণফুলী নদীর বহির্নোঙর থেকে শুরু করে মোহনা পর্যন্ত যেখানেই আমদানিকৃত পণ্য চোরাই হতো সবগুলোতেই ইলিয়াছ নামের এক সিন্ডিকেটের হোতাকে নির্ধারিত কমিশন দিতে হতো। আবার কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে বেশ কয়েকটি চোরাই সিন্ডিকেট রয়েছে। সব চোরাইয়ের ঘটনায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা ব্যবহার হয়। অনেক চুরির সাথে জাহাজের লোকজনও জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।
নৌ-পুলিশে বন্ধ ‘ক্যাশিয়ার’ প্রথা – নগরীর সদরঘাট নৌ-থানা প্রতিষ্ঠার পর থেকে সদরঘাট থানা সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি নৌ-থানারও ক্যাশিয়ার হিসেবে মাসোহারা আদায়ে জড়িত ছিলেন। তবে কোভিড সংক্রমন শুরুর কয়েক মাস আগে থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে ক্যাসিয়ার প্রথাও। পরবর্তীতে আরেকটি চক্র কর্ণফুলী থানাকেন্দ্রিক একজনকে নৌ-পুলিশের ক্যাশিয়ার করতে মরিয়া হয়েও ব্যর্থ হন। সদরঘাট নৌ থানার ওসি এবিএম মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি কিংবা নৌ-পুলিশ ক্যাশিয়ার প্রথাতে বিশ্বাসী নই। যারা আগে থানার ক্যাসিয়ার হিসেবে পরিচয় দিতো তাদের নৌ-থানা এরিয়ায় কঠোরভাবে অবাঞ্ছিত করা হয়েছে।